ডলারের বাড়তি দাম কার্যকর হচ্ছে। ফলে আমদানিতে ডলার কিনতে হবে আগের চেয়ে আরও ৫০ পয়সা বেশি দামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি দিতে হবে। কারণ অনেক ব্যাংক সীমার চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। এতে আমদানি খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও যে কোনো ধরনের কার্ডে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করলে সে ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে এক টাকা বেশি পরিশোধ করতে হবে। নগদ, ড্রাফট বা টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে দেনা পরিশোধ করলেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এতে ভোক্তার খরচ বেড়ে যাবে। ফলে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। এর বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় টাকার মান কমে যাবে। এতে ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতাও কমবে। সব মিলে দুর্ভোগ বাড়বে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে ডলারের দাম আরও এক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্তের আলোকে রোববার থেকে রপ্তানিকারকরা প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ পাবেন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে পেতেন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। রপ্তানিকারকরা বাড়তি পাবেন এক টাকা। প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের ডলারের পাবেন সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আগে পেতেন ১০৯ টাকা। তারা প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা বেশি পাবেন। বেশি দামে ডলার কেনার কারণে ব্যাংকগুলোও বেশি দামে বিক্রি করবে। ফলে আমদানিতে ডলারের দামও ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। আগে বিক্রি হতো ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে। এখন তা বাড়িয়ে ১১০ টাকা করা হয়েছে। কার্ডে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হবে ১১২ টাকা। এটা আগে ছিল ১১১ টাকা।
এ বিষয়ে বাফেদা থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাফেদার মাধ্যমে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এরপর থেকে প্রতি মাসেই ডলারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেণ আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে ডলারের দামও বাড়তে থাকে। মূলত গত বছরের মার্চ থেকেই ডলারের সংকট শুরু হয়। পরে যা প্রকট আকার ধারণ করে। এখন সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। ২০২১ সালের আগে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা, গত বছরের আগস্টে তা বেড়ে ৯৫ টাকা হয়। ওই এক বছরে দাম বেড়েছে ১১ টাকা। এখন প্রতি ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা।
গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১৫ টাকা। গত দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ২৬ টাকা। ওই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ টাকার মান ওই হারে কমেছে। দুই বছরে ১০০ টাকা থেকে শুধু ডলারের দাম বাড়ার কারণে ৩০ টাকা ক্ষয় হয়ে গেছে।
একদিকে পণ্যমূল্য বেড়েছে, অন্যদিকে টাকার ক্ষয় বেড়েছে। ফলে মানুষ চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারছে না। এর প্রভাবে কমে যাচ্ছে জীবনযাত্রার মান। খাদ্য ও চিকিৎসা খাতে ব্যয় কমিয়ে দেওয়ায় মানুষের অপুষ্টিজনিত রোগ যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এছাড়া শিক্ষা, বিনোদন ব্যয়ও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এতে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
ডলারের দাম নতুন করে বাড়ানোর ফলে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়বে। কারণ বাড়তি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হবে। ফলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে। এর সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়বে। আর টাকায় ক্ষয় বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাবে। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। যে কারণে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি হয়েছে অর্থাৎ ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে শহরের চেয়ে গ্রামে আবার মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে। জুলাইয়ে গ্রামে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গ্রামে এ হার এখন ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। যা সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হারের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ যেখানে খাদ্য উৎপাদন হয় ও সরবরাহ বেশি থাকে সেখানেই খাদ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, চাল, গম, সয়াবিন তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দাম গত দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলার থেকে বেড়ে ৮৬ ডলারে ওঠেছে। দুই মাসের ব্যবধানে চালের দাম ৫ শতাংশ, গমের দাম ২ শতাংশ বেড়েছে। এতে আমদানি খরচও আরও বেড়ে যাবে। আমদানির পরিমাণ কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের ওপর চাপ কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে আমদানি খরচও বেড়ে যাবে। এতে ডলারের ওপর চাপ আরও বাড়বে। কমে যাবে রিজার্ভ। তখন ডলারের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জুলাই-আগস্টের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। বর্তমানে নিট রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৩০৭ কোটি ডলার। তখন রিজার্ভ ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঘরে নেমে আসতে পারে। নিট রিজার্ভ এপ্রিলে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ঘরে নেমে আসে। জুনে আকুর দেনা শোধের আগে আবার ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ওপরে ওঠেছিল। আকুর দেনা শোধের পর তা আবার ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে নেমে যায়। এরপর থেকে রিজার্ভ কমতেই থাকে। যা বৃহস্পতিবারের মধ্যে আরও কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঘরে নেমে আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম একটি শর্ত হচ্ছে সব অফিশিয়াল চ্যানেলে ডলারের একক দর নিশ্চিত করা। এ দফায় রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের ডলারের দাম একই করার ফলে ওই শর্ত পূরণে ব্যাংকগুলো এক ধাপ এগিয়ে গেল। আগে রপ্তানির চেয়ে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম বেশি ছিল। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খাতেও ডলারের একক দর প্রতিষ্ঠা করা হবে।