রিন্টু আনোয়ার:
————————-
গত ক’দিন মিডিয়া তোলপাড় করা আরাভ খান ইস্যু সংবাদের বাজারে আর থাকবে ক’দিন? প্রশ্নটা এ কারণেই যে, এর আগে এনু-রূপন দুই ভাইর কিচ্ছাও হারিয়ে গেছে সেই কবেই। এখন কাউকে মনে করিয়ে দিলেও স্মরণে আনা যায় না। ফরিদপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরকতের অবিশ্বাস্য অংকের বিপুল অর্থের মালিক হওয়া ও বিদেশ পাচারের কথাও মানুষকে দিব্যি ভুলিয়ে দেয়া গেছে। তাই প্রশ্ন ঘুরছে আরাব খানের আরব্য রজনীর কাহিনীর চেয়েও পিলে চমকানো সিনেম্যাটিক স্টাইলে খুন, নাম পাল্টে বিদেশ চম্পট, দুবাইতে স্বর্ণের বিশাল শো’রুমের রাজকীয় ঘটনা ক’দনি মনে থাকবে? পরবর্তী কোন ঘটনা অপক্ষো করছে এসব ভুলিয়ে দেয়ার জন্য?
অল্পকথার মাঝে উচিৎ কথার বোম ফাটিয়েছেন তথাকথিত হিরো আলম। তার মতে, পুলিশের এখন উচিত সাকিব ও সেসহ যারা আরাভ খানের শোরুম উদ্বোধনে দুবাই গেছেন তাদের একটা মেডেল দেওয়া। যুক্তিবিদ্যার থিওরিতে বলেছেন, তারা সেখানে গেছেন বলেই তো আরাভের সন্ধান পেয়েছে। নইলে দেশবাসীর অজানাই থেকে যেত আমাদের একজন আরাব খান আছেন। পুলিশের বড় বড় কর্তারা নাকি কিভাবে আরাভ খানদের জন্ম দেন, তাও কি জানা যেত? –হিরো আলমের প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। ক্রিকেট নক্ষত্র সাকিব-হিরো আলমদের উছিলায় অন্তত একজন আরাভ খানতো আবিস্কার হলো। ফেলে দেয়ার মতো নয় হিরো আলমের যুক্তি।
একই সময়ে চিত্রনায়িকা মাহিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি গাজীপুরের পুলিশ কমশিনার মোল্লা নজরুলের ঘুষবাণিজ্য নিয়ে লাইভি করেছেন। এর পর তার ওমরাহ করে দেশে ফিরতে দেরি, বিমান বন্দরে গ্রেফাতে দেরি হয়নি। সোজা আদালত, সেখান থেকে কারাগার। আবার কারা ফটক থেকে জামিনে মুক্তি। ছবির কাহিনী নয়, একবারে বাস্তব। পুলিশ ও আইনের কী যজ্ঞ দেখলো মানুষ। পুলিশ হত্যার আসামী নিয়ে যতি তার শতভাগের একভাগ্ও হতো তা’হলে কী জন্ম হতো একজন আরাভ খানের। মাহির ক্ষেত্রে পুলিশের যে উদ্যম তা আরাভ খাঁনের ঘটনায় ফলাফলটা কেমন হতে পারতো। গোপালগঞ্জের মাছ বেপারি বা ফেরিওলার ছেলে সর্বোচ্চ স্কুল পর্যন্ত পড়াশোর পাঠ নেয়া আরাভ খানদের এখানে তাদের মা-বাবারা জন্ম দেন না। তাদের জনক বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তাসহ রাজনীতিক ও হওমড়া-চওমড়া।
ফরিদপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরকতের অবৈধ বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়া ও কোটি কোটি টাকা বিদেশ পাচারের ঘটনা নিয়েও কিছুদিন এমন হৈচৈ চলেছে। পরে মানুষভুলে গেছে অন্য আরেক ঘটনার তোড়ে। মানুষ জানতেই পারলো না কি করে সম্ভব হলো ক্ষমতাসীন তৃণমূলের সংগঠনের দুই ভাই কিভাবে হলো এমন ধনকুবের। এসব জানানোর ব্যবস্থা না করে বিশেষ ব্যক্তির কয়েকজনকে দৌড়ের ওপর রাখা হয়েছে কয়েকদিন। ওই পরিবারের বাবরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে পরে নানা দুর্নীতি ও একটি মামলা করেন সিআইডি। এতে ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একটি অংশ আনন্দ মিছিল করেছে। আরেক গ্রুপ কষ্ট পেয়েছে। ততক্ষণে ঘটনা ভুলে গেছে মানুষ। পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের দুই নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার ক্ষেত্রেও প্রায় হয়েছে। দুই ক্যাসিনো ব্রাদার এনু ও রুপন কিভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন, অবৈধ অর্থ কাকে কাকে উপঢৌকন দিয়েছেন, কিভাবে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতেন কিছুই জানানো হলো না। অথচ জিজ্ঞাসাবাদে তারা ২২টি বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট ও অন্যসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বড় অংশ ক্যাসিনোর টাকায় কিনেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
এনু ও রুপন ২০১৮ সালে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের পদ পাওয়ার পরপরই এলাকায় তাদের আধিপত্য বেড়ে যায়। তাদের কাছে ভিড়েন এলাকার অনেক প্রভাবশালী। তারা একটা বাহিনীও গড়ে তোলেন। তাদের সঙ্গে ডাকাত শহীদের লোকজনও এসে যোগ দেন।
এনু ও রুপনদের বাসায় এবং তাদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে এনু-রুপনের লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসায় অভিযান চালিয়ে ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআরের কাগজ এবং এক কেজি সোনা জব্দ করে র্যাব। এখন তো আরাভ খানে আগের সব ঘটনা মামুলি বা সামান হওয়া উপক্রম। মরু আরবের শেখদের বালুতে ফোটা এই বিরল প্রজাতির বাঙালি ক্যাকটাসের আরাভ খান দুবাইতে আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটা গয়নার দোকান দিয়েছেন। ৪৫ কোটি টাকা খরচা করে মাত্র ৬০ কেজির সোনায় বানানো বাজপাখি দোকানের কোনায় লোগো হিসেবে বসানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা-ইন্টারপোলের সহায়তায় দুবাই থেকে ধরে আনা হবে আরাভ খানকে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না। বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুসও বড় কড়া। জানিয়েছেন ছাড় নেই সাকিবেরও। দুবাইতে পলাতক আসামি আরাভ খানের স্বর্ণে দোকান উদ্বোধন ঘটনায় সাকিবের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে বিসিবি। এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর সুযোগ আছে কিনা, বিসিবির সাথে সাকিবের চুক্তি খতিয়ে তা দেখা হবে। ধর্ষণ, অসদাচরণসহ নানা গুরুতর অভিযোগ আনার প্রতিবাদে গুলশান থানায় মামলা করতে গেলে শাকিব খানকে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। থানা থেকে অগ্রাহ্য হয়ে তিনি গেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা অফিসে। দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের করা মামলায় আলোচিত চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সকালে গ্রেফতার হয়ে কারাগার, বিকালে জামিনে মুক্ত হওয়া সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। সবই ঘটেছে ঘন্টা কয়েকের মধ্যে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যথারীতি বলেছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগেই তাকে ধরেছে। পরের বাক্যে বলেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মাহির অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।
ওমরাহ সেরে সৌদি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরপরই মাহিকে পাকড়াও করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। দ্রুত আদালতে হাজির, ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন, কারাগারে পাঠানোর হুকুম। সন্ধ্যা আটটার আগেই নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুর জেলা কারাগারে। মূল ফটকে নিতে না নিতেই কারামুক্তি। ভি-চিহ্ন মাহির। ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ফুল ছিটানোর বিনা স্ক্রিপ্টের সিকোয়েন্স। মাহির অপরাধ ফেসবুক লাইভে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুলের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলা। গাজীপুরের ভাওয়াল কলেজ এলাকায় মাহি ও তার স্বামীর গাড়ির শোরুমের জায়গায় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। ঘুষ নিয়ে এতে সহায়তা দিয়েছে পুলিশ। এমনতর অভিযোগে পুলিশের মানহানি হয়েছে। মামলায় কড়া অ্যাকশন পুলিশের। আবার ম্যাজিকের মতো একই আদালত থেকে জামিনে মুক্তি। এর আগে, এই নায়িকা কিছুদিন শিরোনাম ছিলেন পদচ্যুত প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদের গালিগালাজের অডিও ফাঁসসহ ভিন্ন কিছু কারণে। নইলে কে জানতো এঘটনা ?
আরাভ খানের কান টানলে মাথা চলে আসার মতো জানাজানি হয়ে যায় জুয়েলারি দোকানটির মালিক আরাব খানের ঘটনাও সিনেমাকে হার মানানো। এসবি ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাসহ বহু অপকর্মের এই ভিলেনের গডফাদার বড় শক্তিধর। রবিউল, বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুটিয়া গ্রামে। ২০১৮ সালের ৭জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে এসবি ইন্সপেক্টর মামুন হত্যাকাণ্ডের পর আরাভ খান চম্পট দেয় ভারতে। সে তার নামে একজনকে আত্মসমর্পণ করিয়ে জেলেও পাঠায়। আর নিজে ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে পাসপোর্ট করে পাড়ি দেয় দুবাইতে। বেনজীরের স্ট্যাটাস এখন নজিরবিহীনভাবে আলোচনার বিষয়। যে যেভাবে পারছেন আলোচনা জমাচ্ছেন। যার যেমন বুঝ, তেমনই বুঝে নিচ্ছেন। সব গণমাধ্যমে না এলেও যার যা বোঝার বুঝে নিচ্ছেন। বোঝারও তো মাত্রা আছে, সীমা আছে। পুলিশ বা বিভন্নি বিভাগের প্রভাবশারীদের হাতের ছোাঁ লাগলে কারো আরাভ খান হয়ে যেতে সময় লাগে না।
ক্রিকেটের সাবিক বা হিরো আলমরা দুবাইতে না গেলে হয় তো ঘটনা ঘটতো না। একজন আরাভ খানকে চেনা হতো না। শাকিব বা সাকিব বড় বরকতি নাম। এর বাংলা অর্থ- উজ্জ্বল, দ্বীপ্ত, প্রবাহমান ইত্যাদি। তারা সবাই যার যার রাজ্যে উজ্জ্বল, সুপারস্টার। এই তারকাময়তায়ই এখন মাঠ-ঘাট-খাট কাঁপানো আরাভ খানরা একটু ব্যতিক্রম। পাড়া-মহল্লায়ও এদের জন্ম হচ্ছে বিশেষ বিশেষ কারো পরশে। ঘটনা চক্রে কাহিনী ধরা না পড়লে তারা অবলীলায় বেড়ে ওঠে। জাতির কর্ণধার হয়ে যেতেও সময় লাগছে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com