অস্ত্র কিনতে কয়েক কোটি ডলার দিয়েছে ইউক্রেন। কিন্তু এসব অস্ত্র এখনো তারা হাতে পায়নি। মিত্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে পাঠানো সমরাস্ত্রগুলো শুধু অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ইউক্রেন সরকারের নথির তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া আক্রমণ শুরুর পর অস্ত্র কিনতে ঠিকাদারদের ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দিয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুসারে সম্পূর্ণ বা আংশিক অস্ত্রও পায়নি দেশটি।
কিয়েভের অস্ত্র ক্রয়ে জড়িত দুই কর্মকর্তা বলছেন, শুরুতে না পাওয়া অনেক অস্ত্র শেষ পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী অর্থ ফেরত দিয়েছে। কিন্তু বসন্তের শুরু পর্যন্ত কয়েক শ’ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিও রয়েছে। কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি।
অস্ত্র ক্রয়ে কাজ করা এক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভলোদিমির হাভ্রিলভ বলেন, অর্থ পরিশোধ করে অস্ত্র না পাওয়ার মতো ঘটনা রয়েছে। চলতি বছরের আগের অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি পর্যালোচনা শুরু হয়েছে এবং জটিলতা তৈরি করা ঠিকাদারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।
ইউক্রেনের অস্ত্র ক্রয়ের আকারের কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়া ছিল অনিবার্য। গত বছর রাশিয়া আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেনে পশ্চিমা মিত্ররা কয়েক শ’ কোটি ডলারের অস্ত্র পাঠিয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র একাই চার হাজার কোটি ডলার মূল্যের (আর্থিক ও মানবিক সহযোগিতা বাদে) অস্ত্র দিয়েছে। ইউরোপীয় মিত্ররাও কয়েক শ’ কোটি ডলারের অস্ত্র দিয়েছে। এছাড়া ইউক্রেন নিজেও বেসরকারি অস্ত্র বাজার থেকে কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
পশ্চিমা মিত্রদের পাঠানো নিরাপত্তা সহযোগিতায় আধুনিক অস্ত্র ছিল। যেমন- মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা-যা রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মিত্রদের পাঠানোর অস্ত্রের মজুদে ব্যাপক মেরামতের প্রয়োজন পড়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কিয়েভের অস্ত্রাগারে থাকা ৩০ শতাংশ অস্ত্রের যেকোনো সময় মেরামত প্রয়োজন হতে পারে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হার অনেক বেশি এমন সেনাবাহিনীর জন্য যাদের পাল্টা আক্রমণে সম্ভাব্য সব অস্ত্র প্রয়োজন।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্থলযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ বেন বেরি বলেন, ইউক্রেনে অস্ত্র সহযোগিতা পাঠানো কোনো সেনাবাহিনীর প্রধান যদি আমি হলে খুব বিব্রত অবস্থায় পড়তাম এগুলো খারাপ অবস্থায় থাকার কারণে।
সম্প্রতি ৩৩টি স্ব-চালিত হাউইটজার ইউক্রেনকে দিয়েছে ইতালি। ভিডিওতে দেখা গেছে, একটির ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে এবং অপর একটি ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ ছিদ্র হয়ে গেছে।
ইতালির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে এগুলোর ব্যবহার বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন এগুলো চেয়েছে। রুশ আক্রমণের কারণে জরুরি তাগাদার কারণে এগুলো অভিযানে ব্যবহার করতে চেয়েছে কিয়েভ।
ইউক্রেন সরকারের নথিতে দেখা গেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অস্ত্র বিক্রেতাকে ১৯.৮ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে হাউইটজার মেরামতের জন্য। টাম্পাভিত্তিক আল্ট্রা ডিফেন্স করপোরেশনকে এই অর্থ দেওয়া হয় ৩৩টি হাউইটজার মেরামত করতে। জানুয়ারিতে এর মধ্যে ১৩টি ইউক্রেনে পাঠানো হয়। কিন্তু সেগুলো লড়াইয়ে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় ছিল না।
কিয়েভের কর্মকর্তারা মার্কিন কোম্পানির বিরুদ্ধে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এগুলোর মেরামত সম্পন্ন করতে না পারার ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন।
পেন্টাগনের মহাপরিদর্শকের কাছে ৩ ফেব্রুয়ারি লেখা এক চিঠিতে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ক্রয় পরিচালক ভলোদিমির পিকুজো উল্লেখ করেছেন, মার্কিন কোম্পানিটি সেবার প্রস্তাব দিলেও শর্ত পালনের কোনো ইচ্ছা নাই।
কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ হেরিং দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, আমরা যখন এগুলো পাঠাই তখন সবগুলো কাজ করছিল। পাল্টা অভিযোগ করে তিনি দাবি করেছেন, ইউক্রেনীয় উপযুক্ত পন্থায় হাউইটজার রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ও ইউক্রেনের অস্ত্র ক্রয়ে কাজ করা এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পেন্টাগনের মহাপরিদর্শক বিষয়টি তদন্ত করছেন।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বেশিরভাগ সময় ভঙ্গুর বা নষ্ট সরঞ্জাম নিয়ে অভিযোগ করা থেকে বিরত থেকেছেন। যাতে করে দাতারা বিব্রত অবস্থায় না পড়ে।
হাভ্রিলভ বলেন, হাউইটজারের মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এগুলো উপহার।
কিন্তু ইউক্রেন সরকার ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে বলে উল্লেখ করেছেন আরেক সিনিয়র ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা। কারণ বলা হচ্ছে, তাদেরকে পর্যাপ্ত পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ এগুলোর অনেকাংশ এসেছে খারাব বা ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায়। লড়াইয়ে ব্যবহার করা যায়নি, যন্ত্রাংশ হিসেবে কাজে লাগাতে হয়েছে।
এই অভিযোগ মিত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারে আশঙ্কা ও বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে এই ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।