উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য ও সার্টিফাইড কপি ছিঁড়ে ফেলা বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মনিরের বিরুদ্ধে আজ আদেশ দেবেন হাইকোর্ট। এর আগে আদালতে হাজির হয়ে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তা গ্রহণ করেননি।
বর্তমানে বরিশাল জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) কর্মরত মনির এক সময় ছিলেন পটুয়াখালীর মহিপুর ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ওসি থাকার পুরোটা সময় তার বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষকে নানাভাবে হয়রানি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেপরোয়া ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে সংবাদ সম্মেলনসহ বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছেন এলাকাবাসী।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তদন্ত করে রিপোর্ট দেন মনিরের বিরুদ্ধে। তারপরও বহাল আছেন মনির। প্রাইজ পোস্টিংয়ের মতো পটুয়াখালী থেকে এসে তিনি যোগ দিয়েছেন বরিশালের গোয়েন্দা বিভাগে।
পটুয়াখালী শহরের কলেজছাত্র আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় সদর থানায়। ওই মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন আশরাফুল। ১৭ মে জামিন পাওয়ার পর ১৮ মে রাতে তাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকার বিষয়টি জানিয়ে আশরাফুল এ সংক্রান্ত কপি দেন। কিন্তু সেই কাগজ ছিঁড়ে ফেলে পুলিশ। বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনা হলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আজ এই বিষয়ে আদেশ দেওয়ার তারিখ রয়েছে আদালতের।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য আর আদেশের কপি ছিঁড়ে ফেলাই নয়, এর আগেও বেশ কয়েকবার মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। আলীপুর-মহিপুর মৎস্য সমিতির সভাপতি আনসার মোল্লা বলেন, ‘এখানে যোগ দিয়েই ব্যবসায়ীদের ওপর মাসোহারা নির্ধারণ করেন মনির। নির্যাতন থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীরা মিলে দুই দফায় তাকে ১০ লাখ টাকা দিলেও অব্যাহত থাকে হয়রানি। পরে ভবনপ্রতি ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা তাকে দিয়ে করতে হয় কাজ। সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার থেকেও টাকা নিতেন মনির। ২১ সালের ১৩ জুলাই রাতে মহিপুর বন্দর থেকে রওয়ানা হওয়া ৮টি মাছ ধরা ট্রলার তিনি আটকে দেন। পরে ট্রলারপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়ে সমুদ্রে যায় সেগুলো।
কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আব্দুল বারেক মোল্লা বলেন, ‘মহিপুর-কুয়াকাটায় চরম স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছেন মনির। মিথ্যা অভিযোগে তরুণীকে থানায় ২ রাত ১ দিন আটকে রেখে পরে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। দায়িত্ব পালনের দেড় বছরে এই এলাকা থেকে কয়েক কোটি টাকা ঘুস বাবদ আয় করে নিয়ে গেছেন মনির।’
মহিপুর থেকে বদলি হয়ে পটুয়াখালী সদর থানায় যোগ দেওয়ার পরও অব্যাহত থাকে ওসি মনিরের ঘুস বাণিজ্য। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা ড্রেজার ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘পটুয়াখালীতে কাজ করতে এসে আমার ড্রেজারের পাইপ চুরি হয়। থানায় অভিযোগ করতে গেলে উলটো আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ২০ হাজার টাকা নেন ওসি মনির।’ পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের দিনমজুর রবিন দাস বলেন, ‘৫ মার্চ আমার ছেলে গোপাল দাসকে কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। হুমকি দেওয়া হয় মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর। ১৮ ঘণ্টা আটকে রেখে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়াই তাকে।’
২১ ফেব্রুয়ারি মাদক অভিযানের নামে পটুয়াখালী শহরের লোহালিয়া থেকে তুলে নেওয়া হয় রাতুল ও জাকারিয়া নামের দুই তরুণকে। যুগান্তরকে রাতুল বলেন, ‘২২ ঘণ্টা আটকে রাখার পর ওসিকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই দুজন।’ পটুয়াখালীর রফিকুল ইসলাম মুরাদ বলেন, ‘৩ এপ্রিল একটি মামলায় গ্রেফতারের পর অন্য আরও একটি মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা নেন ওসি মনির।’ ইটাবাড়িয়া ইউনিয়নের কলেজছাত্র সায়েম সিকদার বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২২ এপ্রিল বাড়ি থেকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন ওসি। পরে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই।’ ওসি মনিরের বিরুদ্ধে প্রমাণসহ এরকম আরও অন্তত শখানেক অভিযোগ রয়েছে যুগান্তরের কাছে।
পুলিশের একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে ওসি মনিরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ আসে পুলিশ সদর দপ্তরে। ভয়ভীতি দেখানোসহ বিভিন্ন উপায়ে তার অধিকাংশই প্রত্যাহার করান মনির। তবে কলেজছাত্র মহিবুল্লাহকে মানাতে পারেননি। সমুদ্রসৈকতে মোটরসাইকেল নিয়ে নামার অপরাধে মহিপুরের চাকামইয়া গ্রামের মহিবুল্লাহকে থানায় আটকে লাখ টাকা চান মনির। মহিবুল্লাহ জানান, ‘কিছু টাকা দেওয়ার পরও বাকি টাকা পেতে আমার পরিবারের ওপর চাপ দেন মনির। পরে আমার চাচা মোকবুল আহম্মেদ এ ব্যাপারে আইজিপির কাছে অভিযোগ দিলে তা তদন্তের দায়িত্ব পান বরিশাল নৌ পুলিশের তৎকালীন এএসপি আহসান হাবিব পিপিএম।’ আহসান হাবিব বলেন, ‘অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ার পর ওসি মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দিয়েছি। তারপর কি হয়েছে জানা নেই।’
ওই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে যে মনিরের কিছুই হয়নি তার প্রমাণ বরিশাল ডিবিতে তার বদলি হয়ে আসা। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শুরুতেই সবকিছু অস্বীকার করেন মনির। পরে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন এবং কথা বলা সম্ভব নয় বলে তিনি কল কেটে দেন।