• বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ অপরাহ্ন

কার্যকর উদ্যোগে ভাটা পড়ছে মশা নিয়ন্ত্রণে

Reporter Name / ১১৫ Time View
Update : রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩

প্রাণঘাতী রোগের বাহক হয়ে উঠেছে মশা। দেশে বছরের বড় একটি সময় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ মানুষকে ব্যাপক ভোগায়।

ক্ষুদ্র এই পতঙ্গ প্রজাতির মধ্যে এডিস মশার যন্ত্রণা এবার সবচেয়ে বেশি। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না এডিসবাহী ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর সাড়ে চারশর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।

ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমেও মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ডেঙ্গুতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় আজ সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মশা দিবস।

বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষভাবে জনসাধারণকে সচেতন করতে ১৯৩০ সাল থেকে ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর আগে ১৮৯৭ সালের এ দিন (২০ আগস্ট) আবিষ্কৃত হয় মশার সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের সম্পর্ক। আবিষ্কারক ছিলেন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উন্মুক্ত জায়গা। বিশ্বে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। তবে দেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকাতেই ১৪ প্রজাতির মশা রয়েছে।

মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো-ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস। তবে মশাবাহিত অন্যান্য রোগের তুলনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর হিসাব রাখা হয়।

দেশে ২০০৮ সালে প্রথম ডেঙ্গুর মতো একটি রোগ চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। এ রোগটি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর দেশে চিকুনগুনিয়া রোগ শনাক্ত হয়। ঢাকাতে সবচাইতে বেশি চিকুনগুনিয়া রোগী শনাক্ত হয় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে।

গবেষকরা জানান, মশার কামড়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতিবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ। এছাড়াও মশার কামড়ে ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৬০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যান।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. গোলাম ছারোয়ার বলেন, মশা নিধন কতটুকু সফল তার ফলাফল বলা কঠিন। এ জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা নিধন করতে চাইলে মেডিকেল এনটোমোলজিস্ট তৈরি ও গবেষণায় জোর দিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি ও কন্ট্রোল রুম সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৫ হাজার ৫৫১ জন এবং মারা যান ৯৩ জন। ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ এবং ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, মারা যান ২৮১ জন।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা কতটা সফল তা বোঝা যায় মশাবাহিত রোগ কেমন হয়। দেশে এখনো মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা বেশি। দেশে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতার বিষয়ে কোনো মূল্যায়ন কমিটি নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সব দপ্তর পরিবেশ, প্রাণী, রাসায়নিক ও জনসম্পৃক্ততা-এই চারটি উপাদানকে সঠিকভাবে বছরব্যাপী কাজে লাগাতে পারলে মশা নিধন সম্ভব। কোন উপাদান কোন মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে বিশেষজ্ঞরা সেটি বলে দেবেন।

তবে দেশে ডেঙ্গু প্রকোপের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভাগগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মশা মারার নামে নীতি-নির্ধারকরা অবৈজ্ঞানিক পন্থায় হাঁটছেন। এতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মানুষ মারা যাচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তায় নীতি-নির্ধারকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ‘মশা নিধনের নামে তামাশা চলছে। ব্যাঙ, হরিণ আর হাঁস দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা দেখা যায় না। ডোবা-নালায় এডিস মশা ডিম পাড়ে সেটারও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মশা মারার জন্য ফগার মেশিনও কাজ করে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা বলেন, সরকারের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, অন্তত মশা দিবসটাকে কেন্দ্র করে এই বছর না হোক, আগামী বছর থেকে কিছু কার্যক্রম ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত তা করা হয় না। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ও প্রকৃত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। যে ফগিং করা হয় তাতে কিন্তু মশা মরে না। এডিস মশার জন্য যেসব কীটনাশক প্রয়োজন তা নেই আমাদের। গবেষণায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমাদের এমনকিছু লোক থাকতে হবে, যারা সব সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবে। কারণ মশা প্রতিনিয়ত তার ধরন পালটাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু ফয়েজ মো. আসলাম বলেন, মশা নিধনে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনেক ধরনের পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেননি। বিটিআইর চেয়ে আরও কার্যকরী কীটনাশক রয়েছে। যাতে মশা দ্রুত মরে। আজকে বিটিআই আমদানি নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করলে এমন পরিস্থিতি হতো না। বিশেষ করে যারা মশা নিয়ে গবেষণা করছেন তাদের পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করা উচিত।

দেশে ডেঙ্গুর পাশাপাশি ম্যালেরিয়া রোগের প্রভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এর মধ্যে চারটি প্রজাতিকে প্রধান বাহক বলা হয়। পার্বত্য জেলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকার ১৩ জেলায় ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক বলেন, দেশে ২০০০ সালের পর সবচাইতে বেশি ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ২০০৮ সালে। ওই বছর ৮৪ হাজার ৬৯০ জন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং ১৫৪ জন মারা যান। গতবছর শনাক্ত হয় ১৮ হাজার ১৯৫ জন এবং ১৪ জন মারা যান। সবশেষ চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৫ হাজার ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মশাবাহিত আরেক রোগ ফাইলেরিয়া আক্রান্ত মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একসময় এরোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল। সরকারের ফাইলেরিয়া এলিমিনেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটিকে নির্মূল ঘোষণা করা হয়েছে।

জাপানিজ এনসেফালাইটিস নামক মশাবাহিত একটি রোগ হয়ে থাকে। এ রোগটি কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ রোগটি দেশে শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে মধুপুর বন থেকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম খুলনা অঞ্চলে এই রোগটি পাওয়া যায়।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category