মাঝ আকাশে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ হলেও সংকটের মুখে পড়ে বিমান। কেঁপে ওঠে। টালমাটাল খায়। আগুনও ধরে যায় অনেক সময়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ বিমান এয়ারফোর্স ওয়ান থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব বিমানই এই ঝুঁকি থাকে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো-পৃথিবীতে এমনও কিছু অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী বিমান আছে যা শক্তিশালী পারমাণবিক বোমার আঘাতও হজম করে ফেলে নিমিষে। চুল পরিমাণও ক্ষতি হয় না-কেয়ামতের বিমান।
শক্তিতে যেমন দুর্বার, নামেও তেমন ভয়ংকর। শুধু রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের দুই মহাশক্তি, এই দুদেশের কাছেই আছে এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিমান। রাশিয়ার আছে ১০টি। তৈরির পথে আরও একটি। যুক্তরাষ্ট্রে আছে ৪টি। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ সিয়াটলের ঘাঁটিতে প্রথম ই-৪ এ নামের ডুমস ডে প্লেনটির নির্মাণ কাজ শেষ করে ওয়াশিংটন। বলা হয়, রাশিয়ার পারমাণবিক হামলার হাত থেকে বাঁচতেই এই ডুমস ডে বিমান তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র।
মহাযুদ্ধ অথবা মহাপ্রলয়ের দিনকে সাধাণরত ‘ডুমস ডে’ বা ‘কেয়ামতের দিন’ বলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ডিফেন্স নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা মহাযুদ্ধের ভয়ংকর পারমানবিক বোমার মধ্যেও অক্ষত থাকবে দুদেশের এ কেয়ামতের বিমান। এই বিমান থেকেই নিরাপদে বিশ্বযুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাদের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্ণধাররা।
‘ফ্লাইং ক্রেমলিন’ নামের বিমানটিই মূলত রাশিয়ার ‘কেয়ামতের বিমান’। গত বছর মস্কোর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে এক দশকেরও বেশি সময় পর এটি সামনে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে রক্ষা করতে ডিজাইন করা বিশাল এ বিমানটি বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিজয় দিবসে সামনে আনা হয়নি। যদিও এর আগের দিনই মস্কোতে এটি দেখা গেছে। সেদিন সোভিয়েত যুগের সামরিক প্রকৌশলীদের নির্মিত ভয়ংকর এই বিমান দুটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম টিইউ-৯৬ ‘বেয়ার’ ও টিইউ-১৬০ ‘হোয়াইট সোয়ান’ বোমারু বিমান থাকার কথা ছিল।
রাশিয়ায় এই বিমানের উপস্থিতি চিন্তার উদ্রেগ তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। রাশিয়া ও পশ্চিমা সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনার ইঙ্গিত হিসাবে দেখা হচ্ছে একে। অনেকে মনে করছেন, পুতিন বিমানটিকে ন্যাটো এবং তার মিত্রদের সতর্ক করতে সবার সামনে এনেছে। গত বছরের এপ্রিলে পুতিন পশ্চিম থেকে কিয়েভে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দাসহ যুদ্ধে হস্তক্ষেপকারী যে কোনো দেশের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন। সে বছরই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সতর্কতা জারি করেছিল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন পুতিন। ফ্লাইং ক্রেমলিন হলো রাশিয়ায় নির্মিত ইলিউশিন আইআই-৮০ প্লেন, যা আইআই-৮৬ প্যাসেঞ্জার ও কার্গো বিমানের পরিবর্তিত সংস্করণ। বিমানটিতে কোনো জানালা এমনকি কোনো ককপিটও নেই। বায়ুমণ্ডল ও আবহাওয়ার যে কোনো পরিস্থিতিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে পারে এটি। বিমানটি একটি বায়ুবাহিত কমান্ড পোস্ট রয়েছে। বিমানের কাঠামোতে রয়েছে একটি গম্বুজে স্থাপন করা বিশেষ যোগাযোগ সরঞ্জাম। আর এটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারে। যে কোনো পারমাণবিক কোনো যুদ্ধে যদি রাশিয়া এটিকে নির্দেশনা ও ভূপৃষ্ঠে থাকা সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহার করবে। প্রায় একই ক্ষমতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের বহরে থাকা ‘কেয়ামতের বিমান’গুলো ই-৪বি নাইটওয়াচ নামে পরিচিত।
এ বিমান একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের আকাশ থেকে আক্রমণের জন্য কৌশলগত পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর সক্ষমতা রয়েছে। ই৪-বি স্নায়ুযুদ্ধ যুগের অস্ত্র যা ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে চালু হয়েছিল। এটি ১১২ জন লোক বহন করতে সক্ষম। কোনো জ্বালানি ছাড়াই ১২ ঘণ্টা সরাসরি আকাশে উড়তে পারে। উড্ডয়ন করতে প্রতি ঘণ্টায় ১৫৯, ৫২৯ ইউএস ডলার খরচ হয়। বিমানের জানালাগুলো মাইক্রোওয়েভ ওভেনের দরজার মতো একটি তারযুক্ত জাল দিয়ে সজ্জিত কোনো কিছু প্রবেশে বাধা দেয়। বিমানের পেছনের অংশে রয়েছে একটি যোগাযোগ কেন্দ্র। যেখান থেকে বিশ্বের যে কোনো জায়গায় যোগাযোগ করা যায়।
মার্কিন কেয়ামতের বিমানের কাজ কি: কেয়ামতের বিমান জাহাজে থাকা ক্রুদের জন্য একটি উড়ন্ত ঘর হিসাবে কাজ করে। প্রতিটি বিমানের তিনটি প্রধান অভ্যন্তরীণ ডেক বা মেঝে থাকে। সৈন্যদের রাখা হয় মাঝখানের ডেকে। কোনো সংকট বা জরুরি অবস্থা চলাকালীন সব সামরিক পরিষেবার অফিসাররা এখানে এই স্টাফ রুমটিতে মিলিত হন। মূল কেবিনে একটি শব্দপ্রতিরোধী ভিডিও কনফারেন্স রুম ও একটি পৃথক কক্ষ রয়েছে যেখানে প্রতিরক্ষা সচিব ঘুমাতে পারেন। বিমানটিতে রয়েছে ১৪টি বাংক যা কর্মীরা ঘুমাতে ব্যবহার করেন।
বিমানের খরচ: বিমানটি আকাশে থাকা অবস্থায় প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার খরচ হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জ্বালানির মতো স্বাভাবিক ও অত্যন্ত ভারী মানবসম্পদ খরচ। বিমানটি ঐতিহ্যবাহী অ্যানালগ ফ্লাইং যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি। এতে পুরোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা সংযুক্ত থাকায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস বোমাবর্ষণ থেকে এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ। এতে থাকা যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলো ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুত্ত না হওয়ায় হ্যাকিং থেকেও বাঁচায়।
৯/১১ এর সময় ব্যবহার করা হয়েছিল ডুমসডে প্লেন
অভিযোগ করা হয়েছে, একটি ই-৪বি সদৃশ একটি বিমান ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে সন্ত্রাসী হামলার দিন হোয়াইট হাউজের উপর দিয়ে উড়ছিল। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এবং বেসামরিক জনগণ সেই সময়ে এর বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল। তবে এটি সত্যিই একটি ডুমসডে প্লেন ছিল কিনা তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। আর হয়তো হবেও না।
ডুমসড প্লেন নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না কেউ
প্রযুক্তিগতভাবে বলতে গেলে ডুমসডে প্লেনের অস্তিত্ব কোনো গোপন বিষয় নয়। তারপরও মার্কিন এয়ারফোর্স এ বিমানগুলো প্রকাশ্যে আনে না। এমনকি জনসাধারণ বা মিডিয়ার সঙ্গেও এর বিষয়ে কিছু বলতে চায় না।
যে ডুমসডে প্লেনটি সর্বদা নেব্রাস্কায় অবস্থান করে এর সম্পর্কেই সর্বজনীনভাবে স্বীকার করা হয়েছে। মিডিয়ার প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়ছে।
উড়তে থাকা অবস্থায়ও জ্বালানি দেওয়া যাবে
বিমানটি টানা কয়েকদিন আকাশে ঘুরতে পারবে। এমনকি কোনো সংঘর্ষের সময়ও উড়তে থাকা অবস্থাও জ্বালানি দেওয়া যাবে। সফল অবতরণ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে বিমানটিতে একটি জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে।
ফ্লাইটে এরিয়াল রিফুয়েলিংসহ দীর্ঘক্ষণ উড়তে থাকার ক্ষমতা শুধু ইঞ্জিনের তেল খরচের ওপর। তবে বিমানটিকে প্রাথমিকভাবে জরুরি পরিস্থিতিতে পুরো এক সপ্তাহের জন্য বাতাসে থাকতে সক্ষম করে তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষামূলক ফ্লাইটের সময় এটি ৩৫.৪ ঘণ্টা কার্যকরী ছিল। একটি ই-৪বি বিমান সম্পূর্ণরূপে রিফুয়েল করতে মাত্র দুটি কেসি-১৩৫ ট্যাংকার সম্পূর্ণ লোড করে নিতে হবে।