• বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন

কোরবানি: পশুত্বের কাণ্ডগুলো করছে মানুষ

Reporter Name / ১৭৮ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩

সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরুর আগমন রুখতে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে বিজিবি। একটি অসাধু চক্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে বিট বা খাটাল স্থাপনের ভুয়া অনুমোদনপত্র তৈরি করে সীমান্ত দিয়ে গরু আনার চেষ্টার খবর জেনেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ -বিজিবি। বিষয়টি জানতে পেরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে তারা। মন্ত্রণালয় অসাধু ও প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছে। এ মর্মে সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি কিছু চক্র মন্ত্রণালয়ও দপ্তরের ভুয়া অনুমোদনপত্র তৈরি, ভুয়া পরিচয় ব্যবহারসহ নানা রকম প্রতারণার মাধ্যমে গরু চোরাচালানের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে যেন অবৈধভাবে কোনো গরু দেশে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি অভিযানও বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির অ্যাকশনের বার্তা কিছুটা ইন্টারেস্টিং। ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক থামিয়ে চাঁদাবাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন ডিএমপি কমিশনার। তার হুকুম, পশুবাহী কোনো ট্রাক থেকে কোথাও গরু নামাতে বাধ্য করা যাবে না। হাটে নেওয়ার জন্য গরু নিয়ে টানাটানি করা যাবে না।
কোরবানির পশুর হাটের নিরাপত্তা, মানি এসকর্ট, জাল নোট শনাক্তকরণ, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে পুলিশের বিশেষ সমন্বয় সভায়ও হয়েছে। সেখানে ২৫ জুনের আগে কোনো গরু হাটে না ওঠানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রধান-আইজিপির নির্দেশনা আরো কড়া। পশু পরিবহনে কেউ বাধা দিলে নিকটস্থ থানা অথবা জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলেই কড়া অ্যাকশনের বার্তাও দিয়েছেন তিনি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব হুকম বা নির্দেশনার একটিও গরু-ছাগলসহ কোনো পশুর উদ্দেশ্যে নয়। প্রতিটির উদ্দেশ্যেই মানুষ। কোথাও কোনো গরু বা ছাগল কোনো পশুত্বের কাণ্ড বা অনিয়ম করেনি। পশুত্বের কাণ্ডগুলো মানুষেরই করা। ভারত থেকে কখনো কোনো পশু নিজে নিজে আসেনি। তাদের আনা হয়েছে। গরুরা তাদের দাম হাঁকায় না। মানুষই তা করে। বোবা প্রাণীগুলোকে নিয়ে-দিয়ে চাঁদাবাজিসহ পশুত্বের যাবতীয় কারকারবার আশরাফুল মাখলুকাত মানুষই করে। গরু-ছাগলসহ পশুদের হাট পশুরা বসায় না। বসায় মানুষেই। এবার ঢাকা মহানগরে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ২১টি পশুর হাটসহ সারা দেশের হাটগুলোও তাই। এই মানুষেরা আবার যেনতেন মানুষ নয়, হোমড়া-চোমড়া বা বিশিষ্টজন। এবার রাজধানীর আফতাবনগরে পশুর হাট বসাতে দেওয়া ইজারা বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত করতে হাইকোর্ট পর্যন্ত যাওয়া মানুষেরই কাজ। কোনো পশু সেখানে যায়নি। আবার স্থগিত আদেশ চার সপ্তাহের জন্য স্থগিতের যাবতীয় কাজ বাদি-বিদাদি, উকিল-মোক্তার বিচারপতি সবাই মনুষ্য সোসাইটির। পশু কমিউনিটির কেউ নয়।
এবার পশুর প্রচুর উৎপাদন-মজুত মানুষই করেছে।  দামও বেশির ব্যবস্থাও তাদেরই করা। গরুর কোনো ভূমিকা এখানে নেই।  এবার দেশে গতবারের চেয়ে কোরবানির পশুর মজুত বেশি। গত বছরের তুলনায় কোরবানির পশুর দাম বেড়েছে অন্তত ৫ শতাংশ। এদিকে অনলাইনে পশু বেচাকেনা জমানোর কৃত্বিও মানুষেরই। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিডিএফএ ধারনা করছে,  নির্বাচনের বছর হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পশু বিক্রি কিছুটা বাড়বে। ওই নির্বাচনও মানুশেরই কাজ। কোথাও কোনো গরু-ছাগল-ভেড়া ভোটে প্রার্থী হবে না। আগে পশুদের জন্য করা মন্ত্রণালয়ের নাম ছিল পশু মন্ত্রণালয়। এখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয। অধিদপ্তর তো আছেই। তাদের তথ্য বলছে, এ বছর কোরবানিযোগ্য মোট গবাদিপশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। সেই হিসাবে এ বছর কোরবানির পরেও দেশে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু থেকে যাবে।
বিডিএফএ বলছে, গতবার লাইভ ওয়েট বা জীবন্ত পশু ওজনের মাধ্যমে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৪৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। এবার তা শুরু হয়েছে প্রতি কেজি ৪৮০ টাকা দিয়ে। মোটাতাজা গরু লাইভ ওয়েটে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর গোখাদ্যের দাম ৩০ শতাংশের মতো বাড়ানোর কাজটিও মানুষের। ভুসি-খৈল দিয়ে প্রস্তুত করা গোখাদ্য প্রতি কেজি ৩২–৩৫ টাকা থেকে ৫০ টাকার আশপাশে। পানি-বিদ্যুৎ বাবদ খরচও বেড়েছে। তাতে বাজারে গরুর দাম ৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। খাসি বা অন্যান্য পশুর ক্ষেত্রে দাম আরেকটু বেশি বেড়েছে। গতবার লাইভ ওয়েট বা জীবন্ত পশু ওজনের মাধ্যমে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ৪৬০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। এবার তা শুরু হয়েছে প্রতি কেজি ৪৮০ টাকা দিয়ে।
 মানুষের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় গোখাদ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেই অনুপাতে পশুর দাম বাড়ানো যায়নি। সে ক্ষেত্রে খামারিরা লাভের অঙ্ক কমিয়ে গরু বিক্রিতে নেমেছেন। এবার মজুতকৃত পশুর মাাঝে  ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং ২ হাজার ৫৮১টি অন্যান্য প্রজাতির গবাদিপশু। ঢাকা বিভাগে ৮ লাখ ৯৫ হাজার, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৩ হাজার, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার, খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার, বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ ৯৩ হাজার, সিলেট বিভাগে ৪ লাখ ১০ হাজার, রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ লাখ ৯৮ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে।
রাজধানীসহ আশপাশে অনলাইনকেন্দ্রিক গবাদিপশু বেচাকেনা বাড়লেও গ্রামের কোরবানিদাতারা এখনো প্রথাগত গরুর হাটের ওপরই নির্ভরশীল। কোরবানির পশুর হাটে টাকার নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে থাকেন অনেকে। এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পশুর ১০টি হাটে ‘ক্যাশলেস’ বা নগদবিহীন লেনদেনের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব হাটে নগদ টাকার পরিবর্তে কার্ডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করে পশু কেনা যাবে। এ কীর্তি তো মানুষেরই আবিস্কার। তারা ইজারা্ও ঠিক করে। নইলে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা এক একজন পরাক্রমশালী। গেল বছরগুলোতে মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন ‘বসিলা গার্ডেন’-এলাকায় অস্থায়ী হাটটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছিলেন মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আমজাদ হোসেন; যিনি দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের নেতা। এবছরও তিনি নিলামে অংশগ্রহণ করেন। তবে ইজারা পাননি। উচ্চদামে হাটের ইজারা বাগিয়ে নেন এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া।
ক্যাসিনোকাণ্ডে মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. হাবিবুর রহমান মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তারা এই হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর নিজেদের সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলেন তারা। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তারা পুনরায় মাঠ দখলে নেমেছেন, ফিরে পেতে চান নিজেদের আধিপাত্য। এ কারণেই নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দেখিয়ে রাজীবের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত এনায়েত হোসেন ভূঁইয়ার নামে হাটটি ইজারা নেওয়া হয়েছে। দলীয় তেমন পদ-পদবী না থাকলেও ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্তদের সঙ্গে ওঠা-বসার ছবি প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন এনায়েত হোসেন। প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে নেওয়া হাটে লাভ করা তাদের উদ্দেশ্য না। মূলত অনুসারীদের পুনরায় মাঠে একত্রিত করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তারা। সাত গুনের বেশি টাকায় হাটটি নেওয়া হলেও সেই টাকা উঠে আসার সম্ভাবনা না থাকলেও মাঠে নিজেদের জানান দিতে তাদের এই বিনিয়োগ।
এরপরও কোরবানির হাট জমবে। অনলাইনে পশু কিনলে কসাইখানার সুবিধাও মিলবে। মাংস প্রস্তুত করে বাসায়ও পৌঁছে দেওয়া হবে। এসব সুবিধা ঢাকাবাসীর জন্য। অনলাইনে যারা পশু বিক্রি করছেন, তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ভিডিও কল, ছবিতে গরুর সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে দিচ্ছেন। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও অনলাইনে হাটে নানান অফার দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে ফ্রি ডেলিভারি, কেউ দিচ্ছে ক্যাশব্যাক অফার এবং কারও রয়েছে গিফট হ্যাম্পার। নানাভাবে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা। অনলাইন হাটের উদ্যোক্তারা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার এখন পর্যন্ত অনলাইনে চাহিদা কিছুটা কম। তা হওয়ারই কথা।
তারপরও নাম-যশ কামাই করতে বেশি দামে গরু-ছাগল কেনার কৌশল বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বড় সাইজের গরু-ছাগল-মহিষ কিনে এর পেছন-পেছন হেঁটে যাওয়া বা বাড়ির সামনে বেঁধে রাখার সার্কাসের সঙ্গে আমরা পরিচিত।
পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে বসছে অস্থায়ী ১৭টি পশুর হাট। ইতোমধ্যে ১৫টি হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে ৩৭ কোটি ৬৬ লাখ ১৪ হাজার টাকায়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আটটি অস্থায়ী হাটের ইজারা মূল্য ১৭ কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। তবে এই হাটগুলোর সরকারি ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ কোটি ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পেয়েছেন সব হাটের ইজারা। প্রভাব-প্রতিপত্তি মিলিয়ে সারা দেশে অবস্থা কম-বেশি এমনই। সব সৃষ্টির সেরা জীব মানুষেরই হাতে। পশুত্ব-মনুষ্যত্ব- যার যার পারসোনাল ইস্যু। পশুত্বের একটা বিশাল বেনিফিসিয়ারি গোষ্ঠীও তৈরি হচ্ছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে, জাবর কাটছে, মনুষ্যত্বের করুণ পরিণতি দেখছে- এগুলো কি কম সুখের? তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার কাছে আশপাশ থাকছে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাও কি কম তৃপ্তির? হাট,ব্যবসা,কোরবানি সব কিছুই এখন পশু দিয়ে হলেও প্রমাণ’ সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপর নেই।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
-রিন্টু আনোয়ার


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category