গতি নেই সংসদীয় কমিটির কর্মকাণ্ডে। বিশেষ করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বৈঠকে অনুপস্থিতির কারণে কমিটিগুলো অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ নিয়ে কমিটির সদস্যরা নানা দফায় ক্ষোভ এবং অসন্তোষ প্রকাশ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা চলেন একদিকে আর কমিটির সভাপতিসহ সদস্যরা চলেন অন্যদিকে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ অবস্থাটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো কার্যত ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে আসছে দীর্র্ঘদিন ধরে। মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম দেখভাল করা, কোথাও কোনো অনিয়ম কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা ধরিয়ে দেওয়াই মূলত কমিটিগুলোর কাজ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী এবং দলের সিনিয়র নেতাদের প্রধান করে গঠন করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকেও দুজন সাবেক মন্ত্রীকে কমিটির সভাপতি করেন তিনি।
প্রথমদিকে সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যক্রম বেশ ভালোভাবে চললেও মহামারি করোনার সময় বিপত্তি দেখা দেয়। প্রায় দুই বছর বলতে গেলে কোনো কমিটির বৈঠকই হয়নি। তবে করোনার ধকল কাটিয়ে এখন প্রতি মাসেই নিয়মিত বৈঠকে বসছে কোনো না কোনো মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু সমস্যা বেধেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই তাদের অনেকে বৈঠকগুলোতে অনুপস্থিত থাকায় কমিটিগুলো তেমন একটা ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অনুপস্থিতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল’ নিয়ে আলোচনা করতে পারেননি কমিটির সদস্যরা। আগের বৈঠকেও প্রতিমন্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণে বিলটি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা সম্ভব হয়নি।
এর আগে ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল-২০২৩’ উত্থাপন করা হলে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য এটি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি নিয়ে আলোচনার জন্য ১৩ এপ্রিল সংসদীয় কমিটি বৈঠকে বসে। সে দিনও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজানান সুফিয়ান। ফলে বিলটি নিয়ে কোনো আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি কমিটির সদস্যরা।
সূত্র জানায়, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন-এমন নিশ্চিয়তা পাওয়ার পর জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে আহ্বান করা হয় কমিটির বৈঠক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী যোগ দেননি বৈঠকে। এ নিয়ে বৈঠকের শুরুতে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তখন তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতিমন্ত্রী রাস্তায় আছেন। তিনি বৈঠকে যোগ দেবেন। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিমন্ত্রী বৈঠকে যোগ দেবেন না। এতে কমিটির সদস্যরা ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, প্রতিমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। অথচ তিনি আসেন না। বেশির ভাগ সময় অনুপস্থিত থাকেন। এটি দুঃখজনক। কমিটির সভাপতি আরও বলেন, অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও প্রতিমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, কেবলমাত্র শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বেলায় যে এমন ঘটনা ঘটছে তা নয়। হরহামেশাই এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে আরও বেশ কয়েকটি সংসদীয় কমিটির বৈঠকের বেলায়। ১৮ মে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির সভাপতিসহ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত ছিলেন এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী।
১৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমন্ত্রী এই বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী। ৭ মে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৯ মে অনুষ্ঠিত হয় রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক। কিন্তু দুটি সংসদীয় কমিটিরই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছাড়াই।
এর আগে ২৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক। এই মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী আছেন, আছেন প্রতিমন্ত্রীও। কিন্তু তাদের কেউই ছিলেন না বৈঠকে।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অনুপস্থিতি কিংবা কালেভদ্রে উপস্থিত হওয়া সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যত ছায়া সরকার হিসাবে বিবেচিত। মন্ত্রণালয় কী কাজ করছে তার জবাবদিহিতা মূলত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে করতে হয়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা জবাবদিহিতা করতে চান না, কিংবা জবাবদিহিতায় ভয় পান তাই হয়তো তারা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন।