– সাঈদ তারেক।
————————————–
যা নিষিদ্ধ যা নীতিবিরুদ্ধ যা ন্যয়ের খেলাফ, তাই অসিদ্ধ বা হারাম। সেটা ঘুষ হতে পারে, অথবা কাউকে ঠকিয়ে ভয় দেখিয়ে বা চুরি করে যা অর্জন- টাকা সুবিধা বা এমন যে কোন প্রাপ্তিই হারাম বা নিষিদ্ধ বা অন্যায় বলে বিবেচিত হয়। এরূপ কামাই যাদের তাদেরকে সমাজে হারামখোর বলা হয়। এইসব হারামখোরের হারাম কামাই যারা খায় বা ভোগদখল করে তারাও হারামখোর। হারামখোরের সন্তানরা হয় হারামজাদা। আমি চোর-বাটপার লুটেরা দূর্নীতিবাজদেরকে এই দৃষ্টিতেই দেখি। হারাম কামাই যে খায় ভোগ-দখল করে তাকে হারামখোর বলি, খুনীকে খুনী, দূর্নীতিবাজ লুটেরাদেরকে চোর বলি।
আমাদের দেশে হাল আমলে এমন হারামখোরদের বাম্পার ফলন হয়েছে। সংখ্যার কোন সীমা-পরিসীমা নাই। আসুন দেখা যাক কোন কোন তরীকায় বা পদ্ধতিতে হারাম কামাইগুলো সাধিত হয়।
১। ঘুষ- বহুল প্রচলিত একটা পদ্ধতি। অনাদীকাল থেকেই চালু আছে। তবে এক সময় ঘুষখোরদেরকে সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। এদের সাথে কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক করতো না। মিশতো না। পথেঘাটে দেখা হলে এড়িয়ে চলতো। এখন এদের খুব সম্মান। যে যত বড় ঘুষখোর তার তত সম্পদ, তার জন্য তত বড় চেয়ার।
২। অফিস আদালতে ফাইল আটকে টাকা আদায়।
৩। কাগজপত্র ঠিক নাই বা আবার আসেন বলে হয়রানীতে ফেলে টাকা কামাই।
৪। জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে সাব রেজিষ্ট্রারসহ তার অফিসের কেরানী পিওন চাপরাশি এমনকি সুইপার ঝাড়ুদারকে ঘুষ সালামী নজরানা বখশীস দেওয়া। খাজনা দিতে গেলে সেখানেও বাজনা।
৫। চাঁদাবাজী- একেবারে সরাসরি ডাকাতি না তবে এক ধরনের বলপূর্বক টাকা আদায়।
৬। ছিনতাই- কারও টাকা পয়সা বা গয়না মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া।
৭। চুরি। না বলে গোপনে অন্যের টাকা বা কোন সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া।
৮। ডাকাতি। ধরন বদলেছে। এখন সাধারনত: এই পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো ফোকলা করে দেওয়া হয়। ডাকাতদের আদুরে নামকরন হয়েছে ব্যাংক ডিফল্টার বা ঋণ খেলাফী।
৯। ঠ্যাকবাজী। এটাও এক ধরনের ডাকাতি।
১০। টেন্ডারবাজী। যোগ্য এবং হকদারকে বঞ্চিত করে কাজ বাগিয়ে নেওয়া।
১১। কমিশন বাণিজ্য। অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে কাজ নিয়ে দেওয়া বাবদ পারিতোষিক।
১২। ভর্তী বানিজ্য সীট বানিজ্য। ছাত্র রাজনীতির নামে কিছু তষ্কর এই বাণিজ্যটা নিয়ন্ত্রন করে।
১৩। ওভার এস্টিমেটের ঠিকাদারী, নির্মান বা সরবরাহের কাজ। এ ধরনের কাজে সাধারনত: শতকরা ২০/২৫ টাকায় মূল কাজ করে বাকি টাকা ইঞ্জিনীয়ার ওভারশিয়র ইন্সপেক্টর এ্যাকাউন্টস অফিস বড় সাহেব তার বড় সাহেব এবং সবার বড় সাহেব পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া।
১৪। ফুটপাথ বা ভাসমান হকারদের কাছ থেকে নিয়মিতভাবে টোল আদায়।
১৫। গ্রেপ্তার বাণিজ্য মামলা বাণিজ্য ধারা বাণিজ্য রিমান্ড বাণিজ্য জামিন বাণিজ্য খালাশ বাণিজ্য।
১৬। ক্রসফায়ার বা গুম খুন করে ফেলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়।
১৭। পকেটে ইয়ারা বা বা নেশাজাতীয় পদার্থ ঢুকিয়ে টাকা আদায়।
১৮। মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে মাদক ব্যবসার সমন্বয়ের মাধ্যমে যে হারাম কামাই।
১৯। পাড়া মহল্লায় এমনকি অভিজাত এলাকাগুলোয়ও আবাসিক হোটেল নামে পরিচালিত মিনি পতিতালয়গুলো থেকে নিয়মিত অর্থপ্রাপ্তি।
২০। মদ্যশালা নাইটক্লাব ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর থেকে বখরা আদায়।
২১। নিয়োগ বাণিজ্য প্রমোশন বাণিজ্য পোস্টিং বাণিজ্য বদলী বাণিজ্য।
২২। চোরাচালান।
২৩। ব্যাংক লুট। সাধারনত: ব্যাংকের হোমড়াচোমরাদের সাথে যোগসাজসে ভূয়া কাগজপত্র দিয়ে লোন নেওয়া এবং পুরোটাই মেরে দেওয়া।
২৪। ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি। এটা ওপরতলার লোকেরা করে থাকে। এতে লাভবান হয় দুই পক্ষ, যারা ফাঁকি দেয় তারা এবং যারা ফাঁকি দিতে সহায়তা করে এনবিআর কাস্টমসয়ের সংশ্লিস্ট লোকজনেরা।
২৫। ওভার-আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে আমদানী রপ্তানী বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয়ের সিংহভাগ বিদেশে পাচার করা।
২৬। ডাক্তারি মাস্টার্স এমবিএ ইঞ্জিনীয়ারের ভূয়া সার্টিফিকেট বিক্রি।
২৭। শিক্ষা বাণিজ্য, ভর্তী বাণিজ্য কোচিং বাণিজ্য।
২৮। খাদ্যে ভেজাল এবং ইন্সেক্টিসাইড পেস্টিসাইড নামের বিষ মেশানো।
২৯। হোটেল রেস্টুরেন্ট ইন্সপেক্শনের নামে নিয়মিত সেলামী আদায়।
৩০। কালোবাজারি মজুতদারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে জিনিষের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দাম বাড়িয়ে রাতারাতি অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন।
৩১। ভেজাল ও নকল অষুধ প্রসাধনী বিক্রির মাধ্যমে ক্রেতাকে ঠকানো।
৩২। হাইওয়ে চাঁদাবাজী।
৩৩। ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যুর নামে হয়রানীতে ফেলে টাকা আদায়। অর্থের বিনিময়ে নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়া।
৩৪। ইচ্ছাকৃতভাবে লক্করঝক্কর বা ফিটনেসবিহীন গাড়ী রাস্তায় চলতে দেওয়া, যাতে যখন খুশী ড্রাইভারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায়।
৩৫। বাসাবাড়ীতে অবৈধ গ্যাসসংযোগ থেকে মাসোহারা আদায়।
৩৬। বিদ্যুৎ পানি গ্যাসের মিটার টেম্পারিং এবং এ খাত থেকে মাসে শতশত কোটী টাকা পকেটস্থ করা।
৩৭। পাসপোর্ট বানানো নবায়ন বা তথাকথিত ই-পাসপোর্ট বানাতে গেলে এ কাগজ আনেন ও কাগজ আনেন ইত্যাদী ধরনের হয়রানীতে ফেলে টাকা আদায়।
৩৮। এনআইডিতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল করে সংশোধনের নামে গ্রাহককে রাধাচক্কর ঘোরানো এবং ফাইনালি টাকার বিনিময়ে রফা করা।
৩৯। চিকিৎসা বাণিজ্য। রোগীর গলা কাটা, অপারেশনের দরকার না থাকলেও বুক-পেট ফেড়ে ফেলা, অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান, গাদা গাদা অষুধ লেখা, মরা মানুষকে ভেন্টিলেশনে রাখা- ইত্যাকার অপকর্মের মাধ্যমে যে কামাই। এগুলোর সবই হারাম কামাই। যারা এ কামাই খায় তারা শুধু হারামখোর না হাড়েহারামখোর। কত বড় কামিনা এই জানোয়ারগুলো মানুষের জীবনমৃত্যু নিয়েও ব্যবসা করে।
৪০। রিলিফ চুরি এবং টিআর জিআরের গম মেরে দেওয়া। এটা সাধারনত: পল্লী এলাকার গরীব বা ছিচকে চোর হারামখোরেরা করে থাকে।
৪১। কাবিখা বয়ষ্ক ভাতার অর্দ্ধেকটাই গ্রামের টাউট-বাটপারদের খেয়ে ফেলা।
৪২। জন্ম নিবন্ধন মৃত্যু সনদ বা চরিত্রের সার্টিফিকেট দিতে অতিরিক্ত টাকা আদায়।
৪৩। জমি কেনা বাড়ী বানানো এমনকি বাসা ভাড়া দিতে গেলেও কিছু হারামখোরের পেট ভড়ানো।
৪৪। প্রতারনা করে বা টাকা ধার নিয়ে ফেরত দেওয়ার নাম করে মেরে দেওয়া।
৪৫। যৌতুক নামে পাত্র বা পাত্রী পক্ষ থেকে জোর করে টাকা আদায়।
৪৬। জুয়া লটারি ক্যাসিনো হাউজি ইত্যাদী থেকে প্রাপ্ত আয়।
৪৭। অপহরন বাণিজ্য। কাউকে অপহরন করে মুক্তিপন আদায়ের মাধ্যমে যে কামাই।
৪৮। কন্টাক্ট কিলিং। চুক্তির ভিত্তিতে কাউকে মেরে ফেলার বিনিময়ে যে কামাই। এটা বেশী হয়েছে যখন ক্রসফায়ার নামে একটা বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা ছিল।
৪৯। আবাসিক এলাকায় কেমিকেল গোডাউন চালানোর অনুমতি দেওয়ার বিনিময়ে অর্থপ্রাপ্তি।
৫০। হোটেল রেস্তরায় মরা মুরগী পঁচা মাংশ কুকুর বেড়ালের মাংশ দিয়ে খাবার তৈরী, টিস্যু পেপার দিয়ে ছানার সন্দেশ মিষ্টি ইত্যাদী অখাদ্য কুখাদ্য বিক্রি করে যে কামাই।
আমি আপাতত: এই ৫০টা খাত বের করতে পারলাম। আরও অনেক আছে। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা এ তালিকায় আপনাদের জানা অন্যান্য খাতগুলো যোগ করুন, দেখি কত পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়!
চোরকে চোর বলুন। হারামখোরকে হারামখোর বলুন। ওদেরকে ঘৃণা করুন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।