তরুণ ও যুবক বয়সিদের মধ্যে যেকোনো ধরনের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি থাকলেও ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে চলতি বছর আক্রান্তে শীর্ষে রয়েছেন ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা। তবে মৃত্যুর দিক থেকে ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। অপর দিকে, ডেঙ্গুতে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হলেও মৃত্যুতে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এই বয়সিরা কী কারণে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বা মৃত্যুহার কেন বেশি; তার কোনো বিশ্লেষণ নেই সংস্থাটির হাতে। এমন বাস্তবতায় দ্রুত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে ডেঙ্গুর লাগাম টানা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
৭০ বছর গড় আয়ুর বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত কম বয়সিদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি হওয়ায় সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বশেষ তথ্য মতে, ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজারের ঘর পেরিয়ে গেছে। গত ২৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবার ডেঙ্গু ভাইরাসে ৬৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন সবাই।
এদিকে সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত এক দিনে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬০৮ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩৪ জনে। অন্য দিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন ৮ হাজার ৮৪৫ জন ডেঙ্গুরোগী। এক দিন আগেই শনিবার ডেঙ্গুতে এক দিনে রেকর্ড ২১ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৭ জন, চারজন ঢাকার বাইরের। শনিবার সকাল থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৯২ জন, ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৭১৬ জন। এ সময় মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮ জন, ঢাকার বাইরের ৮ জন। চলতি বছরের সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৩০২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬০ হাজার ৪৮৪ জন আর ঢাকার বাইরের ৬৯ হাজার ৮১৮ জন।
চলতি বছর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের পর বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হার বেশি। দেশে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সিদের মধ্যে এ বছর (৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত) ২০ হাজার ১৫৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ১৩ হাজার ৭২৪ এবং নারী ৬ হাজার ৪৩৪ জন। পুরুষ ও নারীর আক্রান্তের হার ১৫ শতাংশ। এই হার অন্য বয়সিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। তাদের মধ্যে পুরুষ আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৯৯৪ এবং নারী ৬ হাজার ২৭৪ জন। এই বয়সি মোট পুরুষ ও নারী আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ২৬৮ জন। আক্রান্ত হার ১৩ শতাংশ। আক্রান্তের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সি শিশু ও কিশোররা। এই বয়সি ছেলে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৭৩ এবং মেয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৭ জন। ছেলে ও মেয়ে মিলে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ১৪০ জন। এ ছাড়া চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়সিরা। এই বয়সি আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ২ জন।
অন্য দিকে ডেঙ্গুতে মৃতের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে রয়েছেন ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা। এই বয়সি মৃতদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৬২ জন। মৃত্যুহার ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ১৯ জন পুরুষ ও ৪৩ জন নারী রয়েছেন, অর্থাৎ ৩৬-৪০ বছর বয়সিদের মধ্যে মৃত্যুতে নারীর সংখ্য বেশি। অপর দিকে, মৃতের দিকে থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়সিরা। এই বয়সি ৪৫ জন নারী এবং ১৪ জন পুরুষসহ মোট ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহার ৯ শতাংশ। মৃত্যুর হিসাবে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা। এদের মধ্যে ২৭ জন নারী ও ১৯ জন পুরুষসহ ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহার ৭ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, কেউ ডেঙ্গুর কোনো সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে পরবর্তীতে সেটিতে আর আক্রান্ত হন না। বয়স্কদের মধ্যে এবং যারা ঢাকায় দীর্ঘদিন বসবাস করছেন, তাদের অনেকেই ডেঙ্গুর একাধিক সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়েছে। ফলে পুনরায় আক্রান্তের সম্ভাবনা কম থাকে। অন্যদিকে যাদের বয়স কম, তারা এক ধরনের আক্রান্তের পরবর্তীতে আরেক ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণরা বাড়ির বাইরে বেশি সময় থাকে। তাদের এডিস মশা কামড়ানোর ঝুঁকিও বেশি। তারা ডেঙ্গুর এক ধরনের পর অন্য ধরনে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, একবার ডেঙ্গুর চারটি ধরনের যেকোনো একটি ধরনে আক্রান্তের পর পরেরবার পৃথক আরেক ধরনে আক্রান্ত হলে শরীরে অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির মধ্যে ক্রস ম্যাচিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেটি কোষের মধ্যে ঢুকে প্লাজমা লিকেজ, প্লাটিলেট ভেঙে ফেলা, ইডিমা বা পেট ও ফুসফুসে পানি জমতে পারে। মাল্টি অর্গান ফেইলুর হতে পারে। একেকবার একেক টাইপে আক্রান্ত হওয়ায় সমস্যায় তরুণ বয়সিরা বেশি মারা যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, এবার বাংলাদেশে একই সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের দুটি ধরন আছে। এর জন্য জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালে রোগী ভর্তি ব্যবস্থায় ক্রুটি থাকতে পারে। রোগীর শরীরের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট এবং অণুচক্রিকা ব্যবস্থাপনা ঠিক হচ্ছে কিনা তার সঠিক চিত্র জানা নেই। আর তরুণরা বেশি আক্রান্ত হওয়ায় মৃত্যুও বেশি হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ডেঙ্গু মৃতুদের ডেথ রিভিউ (মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা) করা হলে সঠিক তথ্য জানা যেত। তখন রোগটি প্রতিরোধের কৌশল গ্রহণ সহজ হতো। দুর্ভাগ্যজনক হলো এখনো এটি সম্ভব হয়নি। ফলে শুধু যুবক বা তরুণই নয় শিশু, নারী, গর্ভবর্তীসহ কোনো বয়সিরই ডেঙ্গুতে জটিলতা ও মৃত্যুর কারণ জানা যাচ্ছে না। সরকারকে বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। দ্রুত ডেথ রিভিউয়ের ফলাফল জনগণকে জানানো উচিত।
ডেঙ্গু হলেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসার কারণ জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী : স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ রিপোর্ট আসার বিষয়ে প্রায়ই রোগীরা অভিযোগ করেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত নন-এমনটা ধরে নিয়েই নির্বিকার থাকছেন অনেকে। পরিস্থিতি খারাপ হলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। তখন চিকিৎসকদেরও কিছু করার থাকছে না। বিষয়টিকে দেরিতে পরীক্ষার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন রোববার তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে উল্লেখ করেছেন। মন্ত্রী বলেন, সঠিক সময়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা না করায় ডেঙ্গুর নেগেটিভ রেজাল্টের সংখ্যা বাড়ছে। আর এই ভুল রিপোর্ট (নেগেটিভ) পেয়ে রোগী বাসায় থাকছে এবং চিকিৎসায় গুরুত্ব দিচ্ছে না। যার কারণে বাড়ছে শারীরিক জটিলতা। তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে যেকোনো জটিলতা এড়াতে জ্বর হওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও এ পরামর্শ দিয়েছেন।