• বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৯ অপরাহ্ন

ডেঙ্গু রোগীর হাহাকার হাসপাতালে শয্যার জন্য

Reporter Name / ১৫২ Time View
Update : শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩

এডিস মশাবাহী ডেঙ্গুর সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। এখন ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে। এ প্রেক্ষাপটে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপে শয্যার জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। অসংখ্য রোগী অন্যের সঙ্গে বিছানা ভাগাভাগি করে হাসপাতালে ভর্তি থাকছেন। নির্ধারিত ওয়ার্ড ছাড়াও বিছানা না পেয়ে রোগীরা হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন উদ্বেগজনক চিত্র দেখা গেছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় ৮৯৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এ বছর প্রতি মাসে যত রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ডেঙ্গুতে জুলাই পর্যন্ত যত রোগী মারা গেছেন, সেটা আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশে। অথচ ‘পিক সিজন’ এখনো আসেনি। চার বছর আগে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা লাখের ঘর ছাড়ালেও চলতি বছর পরিস্থিতি ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা না থাকায় ডেঙ্গু রোগীর ভিড়ে অন্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, হাসপাতালে শয্যার তুলনায় অধিক ভর্তি ও এক বিছানায় একাধিক রোগী চিকিৎসাধীন থাকায় বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ে। এভাবে চিকিৎসক-নার্সরা মানসম্মত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হন। রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না। হাসপাতালে শয্যাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ হওয়ায় অতিরিক্ত ভর্তি থাকলে রোগীদের ডায়েট (খাবার বরাদ্দ) ও ওষুধ প্রদান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ও ডায়াগনোসিসেও সমস্যা হয়। সব মিলিয়ে কোয়ালিটি কেয়ার সম্ভব হয় না।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় ৮৯৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবে এদিন ২৯টি হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ৪০৩ জন ও ঢাকার বাইরে ৪৯৩ জন রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে মোট ৭৫৬ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৬৪ জন ও ঢাকার বাইরে ৩৯২ জন। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় একজন মারা গেছেন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মোট ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মুগদা হাসপাতালে নারী ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় কোনো বিছানা ফাঁকা নেই। সামনের বারান্দা ও খোলা জায়গায়ও সারি করে বিছানা পাতা হয়েছে। কোনো বিছানাতে মশারি টানানোরও ব্যবস্থা নেই। একই স্ট্যান্ডে দুজন রোগীর রক্ত ও সালাইনের ব্যাগ ঝোলানো হয়েছে।

মুগদা হাসপাতালের অষ্টমতলায় শিশু ওয়ার্ডের ডেঙ্গু ইউনিটে গেলে যে কেউ গরমেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। সেখানে প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে আছেন একাধিক আত্মীয়স্বজন। ওয়ার্ডগুলোতে পা ফেলার জায়গা নেই। দুই সারি বিছানার মাঝখান দিয়ে চিকিৎসক-নার্সদের চলাচল করতে হচ্ছে। নির্ধারিত জায়গার পাশাপাশি ওয়ার্ডের ভেতর সুবিধামতো জায়গায় টেবিল পেতে তার ওপর স্যালাইনের ব্যাগের স্তূপ সাজিয়ে বসেছেন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে আসা নার্সরা।

ওই হাসপাতালের নবম ও দশমতলায় পুরুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে। সেখানেও রোগীর চাপে ডেঙ্গু চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের গলদঘর্ম হতে দেখা গেছে। এখানকার চিকিৎসক-নার্সরা জানান, ৫০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই মোট শয্যাসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। অসংখ্য রোগীর চাপ সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বললেন, হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ও লোকবলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রোগী আছে। চিকিৎসক ও নার্সদের নির্ধারিত কাজের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা অতিরিক্ত রুটিন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্যাথলজিতে প্রতিদিন ৩০০ জনের পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এখন ৭০০-৮০০ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে। তবে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তিনতলার ৩১৩ ও ৩১৪ নং শিশু ইউনিটে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে অন্য রোগে আক্রান্ত শিশুরাও ভর্তি রয়েছে। ৩১৪নং ওয়ার্ডের শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় নির্ধারিত আটটা বিছানার সবগুলোতেই দুটি করে শিশু ভর্তি দেখা গেছে। এই ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর বিছনায় ভর্তি রয়েছে ৮ বছরের আনিশা তাসমিম। তার বিছানায় ১১ বছর বয়সি তোহফাকে ভর্তি করেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এক বিছনায় দুই শিশুকে চিকিৎসার বিষয়ে তোফহার বাবা ফিরোজ আহমেদ বলেন, শয্যা না পেয়ে বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। এক স্ট্যান্ডে দুই শিশু রোগীর স্যালাইন ঝোলানো হয়েছে। এক সিলিন্ডারে দিয়ে দু’জনকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।

আনিশা তাসমিমের দাদি বলেন, নাতনি এক সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গুজ্বরে ভুগছে। ভর্তির জন্য সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিন হাসপাতাল ঘুরেও বিছানা পাইনি। সবশেষ এখানে আসি। এখানেও শয্যা ফাঁকা না পেয়ে অন্য রোগীর সঙ্গে বিছানা শেয়ার করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

এই ওয়ার্ডের চিকিৎসক ডা. মিঠুন সরকার বলেন, রোগীর তুলনায় বিছানা কম থাকায় এমনটা করা হয়েছে। তবে সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমতলায় মেডিসিন ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতালের পুরাতন ভবনের ৪টি ওয়ার্ডে প্রায় ৯০টি শিশু ভর্তি রয়েছে। এ হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দুই গুণেরও বেশি সাধারণ রোগী ভর্তি। তাই, ডেঙ্গু রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ড-বারান্দায় স্থান দিতে হচ্ছে।

ঢাকা মেডিকেলের পুরাতন ভবনের ২১০ নম্বর ওয়ার্ড ১ নম্বর বিছানায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে দুই বোন শিশু ইউশা (১১) ও ইউনা (৫)। দুই শিশুর মা সানিয়া আক্তার জানান, গত মঙ্গলবার তার দুই মেয়ে একসঙ্গে জ্বরে আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু পরীক্ষা করে পজেটিভ শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এখানে ভর্তি। পাশেই ২ নম্বর বিছানাতেও ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই শিশু ভর্তি থেকে এক সঙ্গে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই ওয়ার্ডের শয্যার বাইরে মেঝে ও বারান্দাতেও বিছানা পেতে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা নিতে দেখা গেছে।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে রোগীর চাপ সব সময়ই বেশি থাকে। চিকিৎসক, নার্সসহ সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। একাধিক ওয়ার্ডে আলাদাভাবে ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। চিকিৎসকরা সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদেরও চিকিৎসা দিচ্ছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category