নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপমান-অপদস্তের একরত্তিও অবশিষ্ট রাখছে না সরকার। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন মহলের উষ্মা-বিরক্তি ওপেন সিক্রেট। মামলা-মোকদ্দমার সমান্তরালে নোংরা-কদাকার যতো কথাবার্তারও শিকার তিনি। ডালপালা ছড়িয়ে এতে আরো নানা বিষয়আসয় যোগ হয়ে পড়েছে। বিশ্বে ড. ইউনূস নোবেল লরিয়েট, স্যোশাল বিজনেস তত্বের পুরোধাসহ আরো অনেক কিছু হলেও সরকার ও সরকারি দলের লোকদের কাছে তিনি স্রেফ একজন সুদের কারবারি। কর খেলাপি, দেশবিরোধীও। তাকে নোবেল দেয়া ঠিক হয়নি- এমন অভিযোগের সঙ্গে অথনীতির লোক শান্তিতে নোবেল পান কেন-এ প্রশ্ন করে যাচ্ছেন তারা। এসব অভিযোগ ও সমালোচনা নিম্মমানের ভাষায় ঠাঁসা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশাকে তার বিরুদ্ধে একাকার করে দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের চলমান মামলা স্থগিত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দ্যেশে খোলা চিঠি দেওয়া বিভিন্ন দেশের নোবেলজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা নীতি-জ্ঞান বিবর্জিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান
তার নোবেল পুরস্কার নিয়ে টানাটানিও বাদ যাচ্ছে না। তার নোবেল পুরস্কার স্থগিত রাখতে নোবেল কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী। এসবের বিপরীতে তার পক্ষ নিয়েছেন বিশ্বের নামি-দামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ড. ইউনূসকে আইনি প্রক্রিয়ায় ‘নিরবিচ্ছিন্ন হয়রানি’ করা হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকারের উদ্বেগভরা বিবৃতি ছাড়াও জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি ও মার্তা হুরতাদো এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকারকর্মী এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের আইনি প্রক্রিয়ায় হয়রানি করা হচ্ছে যা উদ্বেগজনক লক্ষণ। এতে বলা হয়- ‘এই মামলাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা,’ । হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির মুখোমুখি। তিনি বর্তমানে দুটি বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন যেগুলোতে তার কারাদণ্ড হতে পারে, একটি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং দ্বিতীয়টি দুর্নীতির অভিযোগ।’
তাকে জেল খাটিয়ে ছাড়ার সরকারি আয়োজন ও তৎপরতা অনেকটা স্পষ্ট। ইউনূস প্রশ্নে সরকার নাছাড় বান্দা। শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় আরও ১৮টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই ১৮টিসহ তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৬৮টি। সর্বশেষ ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন শ্রমিক বাদী হয়ে আলাদা আলাদা মামলাগুলো করেন। বিষয়টি উপলব্ধি করে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। এতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা প্রেসিডেন্ট, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব। উক্ত চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন, রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠিটি প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদও দেয়া হয়েছে। এ নিয়েও তীব্র ঊষ্মা সরকারের। ড. ইউনূসের পক্ষে একশ নোবেল বিজয়ীর বিবৃতিকে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ, বলে জানানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের আইনজীবী দিয়ে।
এর আগে, ৪০ জনের বিবৃতির সঙ্গে এবারেরটির কিছু তফাৎ লক্ষনীয়। এতে কেবল ইউনূসকে রক্ষা নয়- বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সরকারের বৈধতার ঘাটতির কথাও এসেছে। এমন ব্যাপক পরিসরে আগে আর কখনো তিনটি বিষয় একসঙ্গে আনা হয়নি। কান টানতে গিয়ে মাথা কাটার এ অবস্থা সরকারের জন্য বিরক্তিকর। অ্যালার্মিংও। এসব মামলায় ড. ইউনূসকে আর হয়রানি না করতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠির শুরুতে “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা” সম্বোধন করে বেশ ক’বার ‘আমরা’ উল্লেখ করে লেখা হয়েছেঃ আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছ।
‘ড. ইউনূসকে টার্গেট করা হয়েছে’-মন্তব্য করে বলা হয়েছে ‘এতে আমরা উদ্বিগ্ন। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রান ‘। এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সরকারের জন্য বিষের মতো। তারওপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা রাখার সুযোগসহ বাংলাদেশ থেকে ‘নিরপেক্ষ বিচারকদের’ একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করার কথাও বলা হয়েছে। চিঠির সমাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশাবাদে বলা হয়েছে- আসছে দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করবেন। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা হয় তা ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখার জন্য আমরা বিশ্বের লাখ লাখ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের শিবিরে যোগ দেবো’। এসব ভাষা সরকারকে রীতিমতো ওয়ার্নিং। স্বাভাবিকভাবেই তা সরকারের জন্য অসহ্যের। এ ছাড়া চিঠিটিতে ড. ইউনূসের নানা প্রশংসা তো আছেই।
এ সময়টাতেই টাইম বোমা ফাটিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এর শিরোনামটিও মারাত্মক-‘নীরবে বিলীন করা হচ্ছে একটি গণতন্ত্রকে, বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে’। ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, এ শিরোনামে প্রকাশিত শিরোনামে বলা হয়েছে, “দেশের ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে সক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা কয়েক ডজন, এমনকি শত শত, প্রতিটি আদালতে মামলার মুখোমুখি হয়ে আছেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে বিরোধী দলকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে। মামলার চার্জ সাধারণত অস্পষ্ট থাকে, এবং প্রমাণ থাকে সবচেয়ে কম, তবুও মামলা চলে। রিপোর্টিতে আরো বলা হয়, প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পাঁচ মিলিয়ন সদস্যের প্রায় অর্ধেক রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আদালতের মামলায় জর্জরিত। উত্তেজনাপূর্ণ মিছিলে অংশগ্রহণ বা গভীর রাতে কৌশল নির্ণয় করার পরিবর্তে আইনজীবীদের চেম্বার, আদালতের খাঁচা এবং ঢাকায়, শামুক-গতির নির্মম যানজটের মধ্যে আটকে যায় সবকিছু ।
সম্প্রতি বা কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে এ ধরনের রিপোর্র আর নজির নেই। যা নোবেল, ড. ইউনূস, সরকার, বাংলাদেশ বা বিশ্বনেতা-কারো জন্যই সম্মানের নয়। এতে সরকার বা দেশ কার কী লাভ হচ্ছে?- এ প্রশ্নের জবাব এখনই মিলবে না। তবে নগদে ক্ষতি বা ইমেজ যে নষ্ট হচ্ছে তা ভরার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের ভেতরের অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছে। বাতাসও ঘুরছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘বিবৃতিতে’ সই না করে বাড়তি বামা ফাটিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেই ফেলেছেন, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তার সম্মানহানি করা হচ্ছে এবং এটা বিচারিক হয়রানি’। আবার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিপ্তরের পক্ষে আইনি লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন দুদুকের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। পরে তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আয়ত্বে আনা হয়েছে। এগুলো সরকারের জন্য সুখকর হলো না। তার চেয়েও বড় কথা, ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্বনেতারা প্রধানমন্ত্রীকে খোলাচিঠি দিলেও এটির মর্মার্থ পানির মত পরিস্কার।
চিঠিতে তারা স্বচ্ছভাবে বলেছেন “আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল”। তার মানে একই কৌশলে নির্বাচনের নতুন চেষ্টাকে তারা কোনো ক্রমেই সমর্থন করবেন না। একই সাথে বিশ্ব নেতারা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনে প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে পাশ কাটিয়ে এক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়টিকে তারা নিরুৎসাহিত করছেন। চিঠির শেষ অনুচ্ছেদে তারা বলেছেন, ’সামনের দিনগুলিতে কীভাবে এই বিষয়গুলি সমাধান করা হয়, তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমরা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের সাথে যোগ দেব’।
এগুলো বাতকে বাত বা বটতলার কথা নয়। এছাড়া চিঠিতে স্বাক্ষর দেয়া ব্যক্তিরা আমাদের কথিত বিবৃতিজীবী নন। উগান্ডা-কঙ্গো, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের কেউও নন। শুধু নিজ দেশের সম্মানিত নাগরিক নন; বিশ্বজুড়ে নন্দিত-গ্ৰহনযোগ্য। তাদের অভিমত-অভিযোগ-অনুযোগের জের না থেকে পারে না। সেই জের কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে-এ প্রশ্নও ঘুরছে চারদিক!
পরিশেষে বলতে চাই,ড. ইউনূস এর সঙ্গে সরকারের আচরণ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এটি বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন সাধারণ নাগরিকও তা বুঝেন।
কিন্তু এ বিষয়টি সরকার বুঝেন না এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বরং সরকার বুঝেশুনেই ঠান্ডা মাথায় ড. ইউনূসকে অপমান করছেন। তাকে সারা বিশ্বে বিতর্কিত এবং তার কৃতিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।
সারাবিশ্বে ড. ইউনূসের অপ্রতিরোধ্য গ্রহনযোগ্যতা এবং খ্যাতি হয়ত মেনে নিতে পারছেন না বর্তমান সরকারের নির্বাহী প্রধান। এটি যদি তার ব্যক্তিগত সমস্যা হয়ে থাকে তবে, তিনি কিন্তু এই সমস্যার সঙ্গে জাতিকে জড়িয়ে ফেলেছেন।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্যা ইকোনোমিস্ট ড. ইডনূসকে নিয়ে কিছুদিন আগে প্রকাশিত আরো একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলো, ‘ড. ইউনুসের জনপ্রিয়তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যিনি ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’
তাহলে কি এই প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, কার নামে পরিচিত হবে বাংলাদেশ ? বঙ্গবন্ধু নাকি ড. ইউনূস?
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট