ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদের লিখিত পরীক্ষায় চাঁদপুরের শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্র সরকার পেয়েছেন ৭৭ নম্বর। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ৪ জুন পাসপোর্ট অধিদপ্তরে মৌখিক পরীক্ষা দিতে আসেন তিনি। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগ কমিটির সদস্যদের কোনো প্রশ্নের উত্তর যথাযথ দিতে পারেননি শ্রীকৃষ্ণ। তখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্যদের সন্দেহ হয়। তাঁকে তাঁর নিজ জেলা সম্পর্কে ১০ লাইন লিখতে বলা হয়। পরে নিয়োগ কমিটির সদস্যদের চোখে ধরা পড়ে, যে লিখিত পরীক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ ৭৭ নম্বর পেয়েছেন, সেই খাতায় যার হাতের লেখা, সেটি তাঁর নয়। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের হয়ে অন্য কেউ লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।
পরে শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি লিখিতভাবে নিয়োগ কমিটির কাছে স্বীকার করেন, তাঁর হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন নাঈম নামের একজন ব্যক্তি। পরে শ্রীকৃষ্ণকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। কেবল শ্রীকৃষ্ণ নন, তাঁর মতো আরও তিনজন লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও পাস করেন। তাঁদের হয়ে অন্যরা লিখিত পরীক্ষা দেন। ওই তিন পরীক্ষার্থী হলেন আশরাফুল ইসলাম, এ কে এম লতিফুর রহমান ও কামরুন নাহার কাকলি। তাঁদের চারজনের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করেছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। চারজনই গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাটি করেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী এম শাহাদত হোসেন। তিনি বলেন, চাঁদপুরের শ্রীকৃষ্ণসহ গ্রেপ্তার চার পরীক্ষার্থীর কেউই লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেননি। অথচ তাঁরা সবাই লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মৌখিক পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। তখন নিয়োগ কমিটির সন্দেহ হলে পরীক্ষার্থীদের নিজ জেলা সম্পর্কে লিখতে বলা হয়। এরপর জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে প্রত্যেক পরীক্ষার্থী লিখিতভাবে স্বীকার করেন, তাঁরা অপরাধে জড়িয়েছেন।
গত ৫ মে ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে) এই পরীক্ষা হয়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানেই পরীক্ষাটি নেওয়া হয়েছিল বলে মামলার বাদী শাহাদত হোসেন জানিয়েছেন।
এই পরীক্ষার জন্য অনলাইনে ফরম পূরণ করার পর প্রার্থীর ছবি–সংবলিত প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেটি মিলিয়ে দেখেন। তারপরও কীভাবে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটল, সে প্রশ্নের জবাবে শাহাদত হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে ঘাটতি ছিল। তাঁরা প্রবেশপত্রের ছবির সঙ্গে পরীক্ষার্থীর চেহারা মিলিয়ে দেখলে জালিয়াতির বিষয়টি হয়তো তখনই ধরা পড়ত।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পাস করা চারজন পরীক্ষার্থীকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কারা তাঁদের হয়ে লিখিত পরীক্ষায় বসেছিলেন, তাঁদের নাম জানা গেছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
শ্রীকৃষ্ণ লিখিতভাবে পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে জানান, নওগাঁর ছেলে নাঈমের সঙ্গে তাঁর এক লাখ টাকায় চুক্তি হয়। নাঈমই তাঁর হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে নাঈম কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, সেটি এখনো জানতে পারেনি পুলিশ। শ্রীকৃষ্ণ নাঈমের যে মুঠোফোন নম্বর পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে দিয়েছিলেন, সেই মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদুর রহিম বলেন, শ্রীকৃষ্ণ যে নাঈমের কথা বলেছেন, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে অন্য যাঁরা পরীক্ষায় অংশ নেন, তাঁদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
গাইবান্ধার এ কে এম লতিফুর রহমান জালিয়াতির মাধ্যমে এই পরীক্ষায় পান ৭৪ দশমিক ৫ নম্বর। লতিফুর জানিয়েছেন, তাঁর হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন রেজা নামের এক ব্যক্তি। তাঁর গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার ফুলবাড়ী থানার মদনপাড়ায়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য রেজার সঙ্গে ৮০ হাজার টাকার চুক্তি হয় তাঁর।
আর লিখিত পরীক্ষায় ৭৫ নম্বর পেয়ে পাস করেন কুড়িগ্রামের কামরুন্নাহার। তাঁর হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন একজন তরুণী। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কাছে লিখিতভাবে মেয়েটির নাম বলতে না পারলেও তাঁর মুঠোফোন নম্বর দেন। সেই মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে ওই মেয়ের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামে। তাঁকে ২০ হাজার টাকা দেন বলে জানিয়েছেন কামরুন্নাহার।
এ ছাড়া আরিফুল ইসলাম নামের পরীক্ষার্থীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তাঁর হয়ে পরীক্ষা দেন জুবায়ের নামের এক ব্যক্তি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য জুবায়েরকে তিনি ৫০ হাজার টাকা দেন।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগ পরীক্ষায় প্রকৃতপক্ষে যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেননি, তাঁদের হয়ে যাঁরা লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা হবে।