‘লৌহমানব’ এরদোগান নাকি ‘তুরস্কের গান্ধী’ কিলিচদারোগ্লু কাকে বেছে নেবেন তুর্কিরা? গত ২ দশক ধরে দেখা আসা পুরোনো ‘একনায়ক’ নাকি এরদোগানের ভুলের ভেলায় ভেসে ‘দ্বীপ’ খুঁজে পাওয়া তুর্কি রাজনীতির নয়া সারেং কিলিচদারোগ্লু? নাকের ডগায় এসে বসা নির্বাচনের সামনে এই ধন্দেই দিন ডুবছে তুর্কি ভোটারদের (৬ কোটি ৪০ লাখ)। তুরস্কের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন তাদের হাতেই।
মতাদর্শের দিক থেকে দুই প্রেসিডেন্টে প্রার্থীর অবস্থানও পুরোপুরি উলটো। ২০ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের এবারের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি একটি শক্তিশালী, বহুপাক্ষিক তুরস্ক গঠন ও ৬০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করা। এরদোগানের অভিযোগ, তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর চেষ্টা করছে পশ্চিম।
এরদোগানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগ্লু। তিনি ন্যাটো সদস্যভুক্ত তুরস্ককে আরও পশ্চিমাপন্থি আর গণতান্ত্রিক অবস্থানের দিকে ফিরিয়ে আনতে চান। দেশে সংসদীয় ও প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা আর স্বাধীন আদালত ও একটি উন্মুক্ত গণমাধ্যম ব্যবস্থা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
তুরস্কের তেপাভ থিংক ট্যাংকের সদস্য সেলিম কোরু বলেন, নির্বাচনে এরদোগান জয়ী হলে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না তুরস্কে। কারণ তার ক্ষমতা ইতোমধ্যে এত বিস্তৃত যে তিনি সেগুলোকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমতায় থাকলে এরদোগান ন্যাটো ত্যাগ করবেন না তবে তিনি তুরস্ককে পশ্চিম থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। কিন্তু কিলিচদারোগ্লু প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থাকে বাতিল করতে চান। আর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই একজন ‘নিরপেক্ষ’ নেতা হতে চান।
কিলিচদারোগ্লু ও তার জোট নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট পদ ও সংসদে জয়ী হলে তুরস্কের অর্থনীতিকে তিনি অর্থোডক্স অর্থনৈতিক নীতিতে প্রত্যাবর্তন করবেন। একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। আরও বলেছেন, তিনি ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনবেন যা পরে আরও কমতে থাকবে।
তুরস্ক পশ্চিমের ন্যাটো প্রতিরক্ষামূলক জোটের অংশ। তবে এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছেন। একটি রুশ এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কিনেছেন। আর রাশিয়ার-নির্মিত একটি পারমাণবিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেছেন।
ইতোমধ্যে তার প্রতিপক্ষ ও তার মিত্ররা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়ায় ফিরে আসতে চায়। আর রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সামরিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চায়।
এরদোগানের ক্ষমতার প্রথম দিকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল। তিনি বিশাল নির্মাণ প্রকল্পগুলোর জন্যও জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার সরকার গোঁড়া অর্থনৈতিক নীতি পরিত্যাগ করেছে। তুরস্ক ধীরে ধীরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করেছে। সুদের হার কমিয়ে আনায় দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে।
তুরস্কের নির্বাচনটি খুব সতর্কতার সঙ্গে দেখছে দেশটিতে অস্থায়ী সুরক্ষায় থাকা সাড়ে ৩ লাখ সিরীয় শরণার্থী। কারণ বিরোধী প্রতিদ্ব›দ্বীরা তাদের ‘সর্বোচ্চ দুই বছরের মধ্যে নিজ দেশে পাঠাতে চায়। যা সিরীয়দের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। চলমান অর্থনৈতিক সংকট আর চলতি বছরে শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর তুরস্কের ৮০ শতাংশ নাগরিক সিরীয়দের নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে।
এখনো ৭০০,০০০ এরও বেশি সিরিয় জনগণ তুর্কি স্কুলে রয়েছে। ২০১১ সাল থেকে ৮৮০,০০০ সিরীয় শিশু তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেছে। এ সম্পর্কে কিলিচদারোগ্লুর মন্তব্য, তিনি দামেস্কের সঙ্গে সিরিয়দের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করবেন। তুরস্কের সরকার বলেছে যে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি সিরীয় শরণার্থী দেশে ফিরেছে।