দেশে-বিদেশে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি চার ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ পরিস্থিতি বাধাগ্রস্ত হওয়া, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং আর্থিক খাতে অস্থিরতা।
আর দেড় বছর ধরে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগুলোর পর এখন অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে এসেছে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের চাপ। এ দুইটিতে এখন সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতি তিন মাস পর এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চাপে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব এখনো অর্থনীতিতে পড়েনি। তবে অর্থনীতিতে চাপ রয়েছে। এক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল। এ দুটি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশই এসব দেশে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমদানির ৭২ শতাংশই আসছে ভারত ও চীন থেকে। রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি আসছে এখন আমেরিকা থেকে। বর্তমানে যে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভূরাজনৈতিকভাবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। এ দুটি দেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক। এছাড়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বেশ কঠোর সমালোচনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ তাদের সমালোচনা মানতে রাজি নয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চীনের দিকে এক পা বাড়িয়ে রেখেছে। যদিও মুখে বলছে সব দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রাখতে বাংলাদেশ মনোযোগী।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি নীতি এমনভাবে বিন্যস্ত করেছে যে গত বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া কিছু বিধিনিষেধ এবং সাম্প্রতিক সময়ের ভিসানীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ রেমিট্যান্স আকারে দেশে চলে আসছে। যে কারণে হঠাৎ করে ওই দেশ থেকে রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে।
সশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এক্ষেত্রে সরকারকে সতর্কভাবে এগোতে হবে। এখনো ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি। যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। এর প্রভাব এখনো আছে। এই যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আঘাত করে যাচ্ছে। আর্থিক খাতে অস্থিরতা ছিল। এখন তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্যের জোগান বাড়ছে। আগামী দিনে এ পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
তারল্যের জোগান বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকট থেকে বাংলাদেশে উদ্ভূত সমস্যার মধ্যে এখনো মূল্যম্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েছে। এ দুটি খাতে এখন সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে হবে এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জোগান বাড়াতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য রপ্তানির নতুন বাজার অনুসন্ধানে আরও জোর দিতে বলা হয়েছে। কারণ, একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানির বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি গত অক্টোবর-ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৭ শতাংশ কমেছে।
একই সঙ্গে রেমিট্যান্স বাড়াতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও প্রবাসীদের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার উদ্যোগকে আরও জোরালো করতে হবে। ইতোমধ্যে এ খাতে হুন্ডির বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বেশ সুফল পাওয়া গেছে। এই ধারাবাহিকতা চলমান রাখলে হুন্ডির প্রবণতা আরও কমবে। তখন প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে আগামী দিনে এ দুই খাতে চাপ কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে এলেও বাংলাদেশে এ হার একটি ঊর্ধ্বমুখী পথ অনুসরণ করেছে। বিশেষ করে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত খাত থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বিনিময় হারের ওপর চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমিয়ে আনা হয়েছে। আমদানি ব্যয় কমার কারণে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি কিছুটা কমেছে। বিনিময় হার ধরে রাখতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এতে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।