বছরের পর বছর আদালতে ঝুলে আছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে করা মামলা। কোনোভাবেই প্রত্যাশা অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সাড়ে ৭২ হাজার মামলা ঝুলে আছে। সেখানে আটকে গেছে পৌনে ২ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। শুধু তাই নয়, দেউলিয়া আদালতেও ঝুলে আছে ১৭২টি মামলা। সেখানেও আছে ৪২৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
এদিকে অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, কোনো কোনো ব্যাংক মামলা করার পর আর কোনো খোঁজখবর রাখে না। বাদী ও আসামি উপস্থিত না থাকায় বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে মামলা। পেছাতে থাকে শুনানির তারিখ। ২০ বছর ধরে মামলার খবর না রাখার নজিরও রয়েছে। এমন কাজ করেছে একাধিক বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এ ঘটনার পেছনে ব্যাংক ও গ্রাহকের জোগসাজশ থাকতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪০টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে আটকে আছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যা ছিল ৭২ হাজার ১৮৯টি বিচারাধীন মামলার বিপরীতে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে বিচারাধীন মামলা বেড়েছে ৩৭১টি। এর বিপরীতে নতুন করে ১১ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আটকে পড়েছে। তারও ছয় মাস আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৩৬৯টি মামলার বিপরীতে ঝুলে ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় ৪৪ হাজার ৬০৫টি মামলার বিপরীতে আটকে আছে ৯৫ হাজার ৯৩৭ কোটি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ১১ হাজার ১৬৬টি মামলায় ঝুলছে ৭৫ হাজার ৯৭৩ কোটি, বিদেশি ব্যাংকে ৮ হাজার ৫২২টি মামলায় আটকে আছে ৩ হাজার ৯১৯ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় ৪ হাজার ৯৩৩টি মামলায় আটকে আছে ২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে বিভিন্ন ব্যাংকের করা মামলার স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৪২৮টি। এর বিপরীতে দেশের বিভিন্ন ঋণখেলাপি থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা টাকার অঙ্ক ২ লাখ ৭০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে মোট আদায় হওয়া টাকার অঙ্ক মাত্র ২৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাস আগে ২০২২ সাল পর্যন্ত মামলার স্থিতি ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩৪৮টি। এর বিপরীতে পাওনা টাকার অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। সেসময় মোট আদায়ের অঙ্ক ছিল ২১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে নতুন করে মামলা বেড়েছে ৬ হাজার ৮০টি, দাবিকৃত টাকার অঙ্ক বেড়েছে ২১ হাজার ৩০৫ কোটি এবং এর বিপরীতে আদায় বেড়েছে মাত্র ২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
ব্যাংকারদের মতে, গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় বেসরকারি ব্যাংক। ফলে তাদের ঋণ আদায়ের হার বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সেটা কম দেখা যায়। কারণ, সরকারি ব্যাংকগুলোয় অনেক সময় ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এসব ঋণ একসময় আদায় না হওয়ায় কুঋণে পরিণত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উলটো চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, এখন বেসরকারি ব্যাংকেরই মামলা দাবির পরিমাণ বেশি। ব্যাংকাররা আরও জানান, কুঋণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক পর্যায়ে আদায় হয় না। আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাই অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মামলা করে থাকে। কিন্তু আদালত পর্যাপ্ত না থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয় ধীরে ধীরে। এভাবেই খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার পাহাড় জমতে থাকে।
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, তারাও এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়ও কুঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর ঋণ আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতে মামলা করতে হচ্ছে। এতে একদিকে ব্যাংকের মামলা পরিচালনায় ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে সময়মতো মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকের টাকা আটকে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা। ফলে অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে।