রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সবস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে প্রত্যেককে তার পরিপূর্ণ হক দিয়ে দেওয়া।
আল্লাহতায়ালা (সা.)-কে অধিক গুরুত্বসহকারে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে-অতএব, তুমি লোকদের (সে বিধানের দিকে) ডাকো এবং নিজে অটল থাকো; যেভাবে তুমি আদিষ্ট হয়েছ। তাদের ইচ্ছার অনুসরণ করো না। বলো, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন আমি তা বিশ্বাস করেছি। আর আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।
আল্লাহ আমাদের প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম। আমাদের এবং তোমাদের মাঝে কোনো বিবাদ নেই। আল্লাহ আমাদের একত্রিত করবেন। তার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। ‘আল-কুরআন, ৪২ : ১৫’ আল-কুরআনের আবেদন অনুসারে তিনি সবাইকে এমন এক সমাজব্যবস্থার দিকে আহ্বান করেন যেটা পরিপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক।
এ জন্য তিনি প্রথম নিজেকে সব ভালো গুণে গুণান্বিত করেন। ন্যায়বিচার, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, ওয়াদা রক্ষা, ক্ষমা, বিনয় ইত্যাদি উত্তম মানবিক গুণাবলি ছোটকাল থেকেই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে তৎকালীন আরব সমাজের নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা তাকে ব্যথিত করত। সে সময় গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত।
তাদের মধ্যে কোনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য বিদ্যমান ছিল না। সরলরা দুর্বলের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাত। সুদের জাঁতাকলে পিষ্ট হতো গরিবরা। আর ধনীরা অর্থনৈতিক নির্যাতনে গরিবদের নিঃস্ব করে দিত।
চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি ছিল আরবদের নিত্যদিনের ঘটনা। তাদের এ অবস্থার বর্ণনায় আল্লাহতায়ালা বলেন-বেদুঈনরা কুফরি ও মুনাফিকিতে অধিক পারদর্শী এবং আল্লাহ তার রাসূলের ওপর যা নাজিল করেছেন তার সীমারেখা সম্বন্ধে তারা অধিকতর অজ্ঞ। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ। ‘আল-কুরআন, ৯: ৯৭’।
সমাজের এ অশান্তিময় অবস্থা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে সারাক্ষণ কষ্ট দিত। তিনি সব সময় চিন্তা করতেন কীভাবে সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়। এ কারণে আমরা দেখতে পাই; নুবুওয়াতের আগেই যুবক মুহাম্মাদ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর নামকরণের ব্যাপারে বলা হয়েছে-কেননা তারা এ মর্মে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তারা নিজেদের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবে।
তাদের কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি কোনো দুর্বল ব্যক্তির ওপর জুলুম করলে তা প্রতিহত করা হবে এবং কোনো স্থানীয় লোক কোনো বিদেশি অভ্যাগতের হক ছিনিয়ে নিলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ‘আবুল ফাদল জামালুদ্দীন ইব্ন মানযুব, লিসানুল আরব, মিসর : আল মাতবাআহ আল-আমিরিয়্যাহ, ১৮৮৫, খ. ১১, পৃ. ৫২’ দাওয়াতি জীবনের প্রথমদিকে একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) বানু হাশিম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বৈঠক আহ্বান করেন।
সেখানে তিনি তার দাওয়াতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন যে, ‘আমি তোমাদের নিকট এমন দাওয়াত নিয়ে এসেছি, যে দাওয়াত দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করবে।’ অর্থাৎ এর মাধ্যমে দুনিয়ায় এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে কোনো অকল্যাণ ও অশান্তি থাকবে না।
আর এ দাওয়াত কবুল করলে আখিরাতেও সফল হওয়া যাবে। এর কিছুদিন পর তিনি কুরাইশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বলেন, আমি যে দাওয়াত পেশ করছি তা যদি তোমরা গ্রহণ করো, তাহলে তাতে তোমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের কল্যাণ নিহিত আছে।
‘ইব্ন হিশাম, আস-সীরাহ্ আন-নাবাবিয়্যাহ, দামেস্ক : দারুন খাইব, ১৯৯৯, খ. ১, পৃ. ৩১৬’ এখানে দুনিয়ার কল্যাণ বলতে দুনিয়ার সামগ্রিক কল্যাণকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবন সর্বাঙ্গীন সুন্দর হবে। সমাজব্যবস্থা নিষ্কলুষ ও নিখুঁত হবে স্থায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। রাসূলুল্লাহর (সা.)-এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে সেখানে ন্যায়-নীতি ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।
এ কারণে কুরাইশদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি আবার আহ্বান করেন এভাবে যে, একটি মাত্র কথা যদি তোমরা আমাকে দাও, তবে তা দ্বারা তোমরা সমগ্র আরব জাতির ওপর আধিপত্য লাভ করবে এবং যত অনারব আছে তারা তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে। ‘প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৬’ মাক্কী জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিরা যখন প্রচণ্ড বিরোধিতা ও নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছিলেন, তখন সাহাবিরা একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তাদের নির্যাতনের কথা বলে এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দোয়া চাইলেন।
তখন তিনি সাহাবিদের সুসংবাদ শুনিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ এ দ্বীনকে একদিন অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন। (ফলে সর্বত্রই নিরাপদ ও শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করবে)। এমনকি তখনকার দিনে একজন উষ্ট্রারোহী একাকী সান’আ থেকে হজরামাউত পর্যন্ত নিরাপদে সফর করবে, অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কারও ভয়ে সে ভীত থাকবে না, এমনকি তার মেষ পালের ব্যাপারে নেকড়ে বাঘের আশঙ্কাও তার থাকবে না।
কিন্তু তোমরা (ওই সময়ের অপেক্ষা না করে) তাড়াহুড়া করছ। ‘ইমাম বুখারি, আস-সহিহ, অধ্যায় : আল-মানবিক, পরিচ্ছেদ : আলামাতুন নুবুওয়্যাতি ফিল ইসলাম, বৈরূত : দারু ইবনি কাছিব, ১৪০৭ হি./১৯৮৭ খ্রি:, হাদিস নং-৩৪১৬’ এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিলেন, যেটা সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিময়।
যেখানে কোনো চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানি ও লুণ্ঠন থাকবে না। কেউ অন্যের জান-মাল, ইজ্জত, সম্ভ্রম অন্যায়ভাবে স্পর্শ করার সাহস করবে না। বাস্তবিকই রাসূল (সা.) এ রকম এক শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হিজরতের পর আদী ইব্ন হাতিম (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তাকে নানাভাবে পরখ করতে লাগলেন। এ সময় রাসূল (সা.) আগন্তুকের চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অনেক কথাই বললেন। এক পর্যায়ে তিনি ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন-অচিরেই তুমি শুনবে, এক মহিলা সুদূর কাদিসিয়া থেকে একাকী তার উটে সওয়ার হয়ে এ মসজিদ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে এবং সম্পূর্ণ নির্ভয়ে এসে পৌঁছেছে।
সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি হিজরতের পর মদিনার জীবনের প্রথমেই মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করেন। যেটি ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ’ হিসাবে স্বীকৃত।