ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এ চাপ সামলাতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে উন্নয়ন সহযোগীদের কিস্তি পরিশোধের পর নিট বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ কমছে। এদিকে জুলাই ও আগস্টে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের বিপরীতে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। ফলে শেষ পর্যন্ত অর্থ ছাড় আরও কমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি না এলে বৈদেশিক অর্থ ছাড় করে না উন্নয়ন সহযোগীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিকে অর্থপ্রাপ্তি কমবে, অপরদিকে ঋণ পরিশোধ বাড়তে থাকলে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া বৈদেশিক অর্থ খরচের ক্ষেত্রে ৮৬ ধরনের প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বুধবার গনমাধ্যমকে বলেন, সব সময় বৈদেশিক সহায়তা একরকম ভাবে আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। কোনো মাসে বেশি আসবে, আবার কোনো মাসে কম আসবে। ‘আপস অ্যান্ড ডাউন’ থাকবেই। এটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এখনো আমরা প্রচুর বৈদেশিক ঋণ নিতে পারি। ঋণ গ্রহণের যে বিপৎসীমা তার অনেক নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা কখনোই কিস্তি পরিশোধে খেলাপি হইনি। সুতরাং আগামীতেও খারাপ কিছু হবে না।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বছরে এখন প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ২০২৬ সালের পর এটি বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারে। কিন্তু সেই তুলনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়ে তাহলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। সরকারি বাজেটে সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে। আবার বাজেটের চাপ সামলাতে ডলার যথেষ্ট না থাকলে ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টে’ চাপ আসার আশঙ্কা আছে। বর্তমানে বড় চাপ হচ্ছে বহির্বাণিজ্যের আর্থিক লেনদেনে ঘাটতি। এর মূল কারণ হলো, বেসরকারি স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা। আগে ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি আবার নতুন ঋণ আসত। এখন আস্থার সংকটে নতুন ঋণ আসছে না। বা এলেও নানা রকম শর্ত ও সুদ বেশি চাওয়া হচ্ছে। এদিকে সরকার ইতোমধ্যেই দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব চড়া সুদে ও স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিয়েছে সেগুলো এখন পরিশোধের সময় এসছে। ফলে ঋণ পরিশোধের চাপ দিন দিন বাড়টাই স্বাভাবিক।
ইআরডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেই (জুলাই) কমেছে বৈদেশিক সহায়তা অর্থ ছাড়ের পরিমাণ। এ মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা প্রায় পাঁচ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে তুলনামূলক ছাড় হওয়া অর্থের পরিমাণ কমেছে ৮৬৯ কোটি টাকা। পাশাপাশি জুলাইয়ে বাংলাদেশ সুদ-আসলে পরিশোধ করেছে ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। টাকার অঙ্কে প্রায় দুই হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ হিসাবে দিয়েছে ১০ কোটি ৬০ লাখ ডলার, বা প্রায় এক হাজার ১৫৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আসল পরিশোধ করেছে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বা প্রায় এক হাজার ৫০৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে একই সময় বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা প্রায় এক হাজার ৬৮০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করেছে ছয় কোটি ৪৬ লাখ ডলার বা ৬০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এছাড়া আসল পরিশোধ করেছে এক কোটি ১৪ লাখ ডলার বা প্রায় এক হাজার ৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরের এক মাসে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলার, বা প্রায় এক হাজার ৭১ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
ইআরডি’র সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ বেশি দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া সবসময় বৈদেশিক ঋণ প্রাপ্তি ও পরিশোধ সমান্তরাল ভাবে চলবে না। এটা দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
ইআরডি জানায়, জুলাইয়ে প্রতিশ্রুতি এসেছে ৫ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি এসেছে বেশি।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে বরাদ্দ আছে ১৫ হাজার ১৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। শূন্য অগ্রগতি হয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া আইন ও বিচার বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপিতে) মোট বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ রয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ২ মাসে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বছর বছর কমছে বৈদেশিক অর্থের খরচ। এক্ষেত্রে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যে লক্ষ্য ধরা হয় মাঝপথে এসে সেটি করা হয় কাটছাঁট। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাস্তব খরচ হচ্ছে আরও কম। এদিকে বৈদেশিক ঋণের অর্থ খরচ করতে না পারায় বাড়ছে পাইপলাইন। এক্ষেত্রে কোন কোন ঋণে গুনতে হচ্ছে কমিটমেন্ট এবং প্রতিশ্রুতি ফির মতো অনাকাক্সিক্ষত ফিও। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ঋণের এ অর্থ ব্যয় না হওয়ার নেপথ্যে ৮৬টি কারণ খুঁজে পেয়েছে আইএমইডি। বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে চিহ্নিত বাধাগুলোর অন্যতম কয়েকটি হলো-বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমদানি নির্ভর সামগ্রী আমদানিতে সমস্যা হওয়ায় প্রকল্পের গতি কম হয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী এক্সিম ব্যাংকের ক্রয়সংক্রান্ত ডকুমেন্ট যথাসময়ে অনুমোদন না হওয়া এবং কোভিড-১৯ এর সময় কার্যক্রম বন্ধ থাকা। আরও আছে ব্যক্তি পরামর্শক ও পরামর্শক ফার্ম নিয়োজিত এবং এসএমই পর্যায়ে ভ্যালু চেইন বিষয়ে উপযুক্ত মানসম্মত প্রার্থী না পাওয়া।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সময়মতো কাজ শুরু না করা। নির্মাণ সামগ্রীর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংক ফ্রেমওয়ার্ক প্রকল্পের প্রতিটি পর্যায়ে সংস্থাটির অনুমোদনের পর প্রকল্পের ভৌত কার্যক্রম শুরু করতে হয়। দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়া। ড্রয়িং ডিজাইন এবং মনিটরিং ফার্ম নিয়োগে বিলম্ব। প্রতিবেদনে তুলে ধরা আরও কয়েকটি কারণ হচ্ছে, রেলওয়ের স্থাপনা ও নির্মাণ খাতে প্রকল্প সাহায্য অংশে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের বিপরীতে ম্যাচিং ফান্ড হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা না থাকা এবং ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি।