বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও ইসরাইলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদিকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নূর মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিনা, তা নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। সাক্ষাতের খবর নাকচ করে দিয়ে নুর বলেছেন, এ সবই অপপ্রচার।
তবে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে মেন্দি এন সাফাদি বলেছেন, তার সঙ্গে নূরের সাক্ষাৎ হয়েছিল। গত ২৬ জুন মেন্দি এন সাফাদি মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়ে এসব কথা জানিয়েছেন। তার মুঠোফোন নম্বরটি সাফাদি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসি, রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস নামে ফেসবুক পেজ থেকে সংগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠানের বোর্ড মেম্বার হিসেবে তার নাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইসরাইলের বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসরাইলি করপোরেশনস অথরিটিতে নিবন্ধিত।
২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশে মেন্দি এন সাফাদির নাম প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতে ইসরাইলিদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। শিপন কুমার বসু নামের এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় মেন্দির সঙ্গে আসলামের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আগ্রায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সে সময় মেন্দি ভারত সফর করছিলেন। মেন্দির সঙ্গে সাক্ষাতের খবর বের হওয়ার পর ওই বছরের ১৫ মে আসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় রাজধানী থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এক বছর পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরে তার বিরুদ্ধে দুদকের দুর্নীতি মামলাসহ একাধিক মামলা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মেন্দি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট। তিনি মোসাদের এজেন্ট—এ ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায়নি। আবার তিনি যে মোসাদের এজেন্ট নন, সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মেন্দি এন সাফাদিকে নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন ছেপেছে। এসব প্রতিবেদন থেকে তাঁর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
নাগরিকত্ব আইনে ফিলিস্তিনিদের আইন করে সম–অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১৯ সালে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই আইনের পক্ষে মেন্দি এন সাফাদি তার অবস্থানের কথা জানান।
ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকা গোলান মালভূমি এলাকার বাসিন্দা মেন্দি এন সাফাদি ইহুদি নন। তিনি দ্রুজ ধর্মাবলম্বী। দুবাইয়ে ব্যবসা করেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনমত জরিপ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার ‘ফাইভ ফ্যাক্টস অ্যাবাউট ইসরাইলি দ্রুজ, আ ইউনিক রিলিজিয়াস অ্যান্ড এথনিক গ্রুপ’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। সেখানে বলা হয়েছে, ইসলাম ও হিন্দুধর্ম এবং গ্রিক দর্শন এই ধর্মের ভিত্তি। প্রতিবেদন বলছে, এই ধর্মের আবির্ভাব ১১ শতকে। সিরিয়া ও লেবাননে দ্রুজ সম্প্রদায়ের ১০ লাখের ওপর মানুষ আছেন। এ ছাড়া ইসরাইল ও জর্ডানে দ্রুজরা আছেন। ইসরাইলে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ দ্রুজ। সংখ্যালঘু আরব হওয়া সত্ত্বেও দ্রুজরা ইসরাইলে ইহুদিদের মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে থাকেন। সেনাবাহিনীতে দ্রুজদের একটি আলাদা পদাতিক ইউনিট আছে, যেটির নাম ‘হেরেভ’ (তরবারি ব্যাটালিয়ন)।
মেন্দি এন সাফাদি ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক। ইসরাইল ২০১৮ সালে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন পাস করে। ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের জন্ম হয়। সে সময় ওই অঞ্চলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের নাগরিকত্ব পান। তবে তারা কখনোই নাগরিক হিসেবে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেননি। নাগরিকত্ব আইনে ফিলিস্তিনিদের আইন করে সম–অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১৯ সালে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই আইনের পক্ষে মেন্দি এন সাফাদি তার অবস্থানের কথা জানান।
মেন্দি কতটা প্রভাবশালী
মেন্দি এন সাফাদি আদৌ প্রভাবশালী ব্যক্তি কি না, তার জবাব পাওয়া যায় আউজ সেভা ইসরাইলি নামের একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ২০১৯ সালের ২৩ জুন প্রকাশিত ‘হোয়াই লিকুদ ভোটারস শুড সাপোর্ট মাইনরিটি ক্যান্ডিডেটস’ নামে ওই লেখায় ইহুদি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষায় দ্রুজরা কী ভূমিকা রাখছেন, তার বিশদ বিবরণ ছাপা হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথমেই নাম ছিল আইয়ুব কারারের। মেন্দি এন সাফাদি এই আইয়ুব কারারের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। আইয়ুব ১৯৯৯ সালে সংসদ সদস্য হন। তিনি ডেপুটি স্পিকার ও ফরেন ওয়ার্কার্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অল্প সময়ের জন্য সংসদের বাইরে থাকলেও ২০০৯ সালে তিনি আবারও সংসদে ফেরেন। সে সময় তিনি উপমন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। প্রতিবেদক লিখেছেন, আইয়ুব কারার ইসরাইলের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সত্যিকারভাবেই সম্পদ।
একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেন্দি এন সাফাদির রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ব্যাপক। সাফাদি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসি, রিসার্চ, পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস প্রতিষ্ঠা করে তিনি বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তিনি সিরিয়ার বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাহিনীকে সহযোগিতা ও স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষেও জনমত গঠনের কাজ করছেন। এমনকি তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় যুক্ত আছেন। কূটনৈতিক সম্পর্কের অংশ হিসেবে তিনি নিয়মিত ভারত, আজারবাইজান, ইউরোপ ও এশিয়ায় ভ্রমণ করেন।
বাংলাদেশ নিয়ে মেন্দি এন সাফাদির আগ্রহের কারণ কী, আদৌ আগ্রহ আছে কিনা, তা নিয়ে পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা আছে। মেন্দি এন সাফাদিকে এ প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেননি। ২০১৬ সালের ৭ জুন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান দ্য স্ক্রল–এ মেন্দি এন সাফাদিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন। ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশের ব্যাপারে আদৌ ইসরাইলের কোনো আগ্রহ আছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এই প্রতিবেদনে।
ফেসবুকে বাংলাদেশ নিয়ে পোস্ট
বাংলাদেশের সঙ্গে মেন্দি এন সাফাদির যোগাযোগের সূত্র বাংলাদেশি নাগরিক শিপন কুমার বসু। সাফাদি সেন্টারের ফেসবুক পেজে শিপনের সঙ্গে মেন্দি এন সাফাদির অনেক ছবি রয়েছে। তিনি এক ভিডিও বার্তায় শিপনকে তার মুখপাত্র হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তবে এ বছরের ৭ এপ্রিল তিনি ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা আমাকে ও শিপন কুমার বসুকে জানেন, তাদের একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিপন আমার নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের কাছে থেকে টাকা নিয়েছে। এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, এবং আমি এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা আমি জানি না। আমি সবাইকে সতর্ক করতে চাই যে আমার পক্ষ হয়ে কথা বলার জন্য আমি কাউকে দায়িত্ব দিইনি। আমি আশা করি, উপযুক্ত লোকজনকে দিয়ে আমি বাংলাদেশিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে সক্ষম হব এবং পরিবর্তন আনব।’
আমার মনে হচ্ছে, কেউ টাকাপয়সা দিয়ে লবিং–তদবির করে একটা মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়াতে পারেন। আমি যত দূর জানি, তিনি নিজেও একটি লবিস্ট ফার্ম পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। আগে পাসপোর্টেও বাংলাদেশের নাগরিকদের ইসরাইল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। সম্প্রতি এই লেখা সরকার উঠিয়ে নিয়েছে। তাহলে কি বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে? এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কেউ পরিষ্কার করে কিছু বলেননি। তবে এ বছরের ১০ জানুয়ারি ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ লিখেছে, ইসরাইলের সাবেক একজন গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত একটি কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক রপ্তানি রেকর্ডের বরাত দিয়ে তারা এই খবর প্রকাশ করে।