পবিত্র রমজানে দোয়া কবুলের বিশষ সময়গুলোর মধ্যে রাতের শেষাংশ অন্যতম। এই সময় আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া কবুল করেন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য শেষ রাতের দোয়া-প্রার্থনার বিকল্প নেই। পবিত্র কোরআনে এসময়ের দোয়া ও প্রার্থনার প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং শেষরাতে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
নবীজি (স.) বলেন, ‘রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে আমাদের প্রতিপালক পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন—কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব, কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব, কে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (সহিহ বুখারি: ১১৪৫)
তাই রোজাদার মুসলমানের উচিত, সেহেরির আগে বা পরে তাহাজ্জুদ আদায়ে সচেষ্ট হওয়া এবং এ সময় আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও কল্যাণ প্রার্থনা করা।
শেষ রাতের বিশেষ ইবাদতের নাম তাহাজ্জুদ। ওই সময়ে সবাই গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকলেও কিছু বান্দা মহান প্রভুর স্মরণে বিছানা ছেড়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যান। আল্লাহ তাআলা ওসব শয্যাত্যাগকারীদের প্রসঙ্গ পবিত্র কোরআনে তুলে ধরেন এভাবে—‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও আশায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।’ (সুরা সাজদা: ১৬)
মহানবী (স.) বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের তাহাজ্জুদের নামাজ’। (মুসলিম: ১১৬৩)
রমজান মাস হচ্ছে রহমতের মাস, ক্ষমা পাওয়ার মাস, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়ার মাস। তাই এই মাসের তাহাজ্জুদ স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর কাছে অনেক বেশি পছন্দনীয়। আবার রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় খুবই সহজ, যেহেতু সেহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হয়। তাই চাইলেই সেহরির আগে বা পরে তাহাজ্জুদ আদায় করে নেওয়া যায়। মহান মালিকের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য, কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার জন্য, নিজের চাওয়াগুলো তুলে ধরার জন্য এই সহজসাধ্য আমলটি রমজানে মিস করা একজন মুমিনের জন্য কোনোভাবেই উচিত নয়।
রাসুলুল্লাহ (স.) প্রতিরাতেই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। নবীজি (স.)–এর জন্য এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত নফলের মধ্যে তাহাজ্জুদ সর্বোৎকৃষ্ট আমল। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সেই স্বামীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্ত্রীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানিছিটা দেয়। আল্লাহ তাআলা সেই স্ত্রীর প্রতি রহম করেছেন, যে নিজে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার স্বামীকে জাগায়। যদি সে উঠতে অস্বীকার করে, তবে তার মুখমণ্ডলে পানিছিটা দেয়।’ (আবু দাউদ ও নাসায়ি, আলফিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৯৭, হাদিস ৪০৭)
ভোররাতের ইবাদতের এতই ফজিলত যে, ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা না থাকলে ঘুমানোর আগে অন্তত দুই রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তে উৎসাহিত করতেন প্রিয়নবী (স.)। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘রাত্রি জাগরণ কষ্টকর ও ভারী জিনিস, তাই তোমরা যখন (শোয়ার আগে) বিতির পড়বে তখন দুই রাকাত (নফল) নামাজ পড়ে নেবে। পরে শেষ রাতে উঠতে পারলে ভালো, অন্যথায় এই দুই রাকাতই ‘কিয়ামুল লাইল’-এর ফজিলত লাভের উপায় হবে।’ (সুনানে দারেমি: ১৬৩৫; সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১১০৬; তাহাবি: ২০১১)
শেষরাতে বিশেষ এক দোয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় হাদিসে। যে দোয়া অবশ্যই কবুল করা হয়। উবাদা ইবনে সামিত (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে নিচের দোয়াটি পাঠ করে অতঃপর বলে ‘প্রভু! আমাকে ক্ষমা করো’, তাকে ক্ষমা করা হয়। রাবি ওলীদ ইবনে মুসলিমের বর্ণনায় আছে, এ দোয়া করলে তার দোয়া কবুল করা হয়। অতঃপর সে উঠে গিয়ে অজু করে নামাজ পড়লে তার নামাজ কবুল করা হয়। (ইবনে মাজাহ: ৩৮৭৮)
দোয়াটি হলো—لا إلهَ إلاَّ اللَّه وحْدهُ لاَ شَرِيكَ لهُ، لَهُ المُلْكُ، ولَهُ الحمْدُ، وَهُو عَلَى كُلِّ شَيءٍ قَدِيرٌ – سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ للهِ وَلَا إلَهَ إلّا اللهُ، وَاللهُ أكْبَر – وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إلَّا بِالله উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার; ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ। অনুবাদ: আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তার কোনো শরীক নেই। তার জন্যই সকল রাজত্ব ও তার জন্যই সব প্রশংসা এবং তিনিই সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী। মহাপবিত্র আল্লাহ। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। নেই কোন ক্ষমতা নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত। অতপর বলবে- ‘রাব্বিগফিরলি’ অর্থাৎ হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন। (ইবনে মাজাহ: ৩৮৭৮)
উল্লেখ্য, রাতের দুই–তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তথা রাত দুইটার পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত আরম্ভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিশেষ কল্যা তাহাজ্জুদের সময়। সেহরির সময় শেষ হলে তথা ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলে তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত শেষ হয়। দুই রাকাত করে আট রাকাত বা ১২ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া যায়, আবার কম-বেশি হলেও সমস্যা নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পবিত্র রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় ও বেশি বেশি দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।