রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে রাজনীতি ক্রমশ চলে যাচ্ছে অন্যদের দখলে।
বিশেষ করে সামজের নানা স্তরে আমলাতন্ত্র প্রবলভাবে জেঁকে বসায় অনেকটাই পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন দেশের প্রকৃত রাজনীতিকরা। সংসদে, এমনকি সংসদের বাইরে এ নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ-বিক্ষোভ হলেও কার্যত কোনো কাজ হচ্ছে না।
তারা বলেন, রাজনীতিবিদরাও তাদের হাত থেকে রাজনীতির বাঁধন আলগা হওয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী। একে অপরের প্রতি আস্থাহীনতা, দূরত্ব, সন্দেহ-অবিশ্বাস, নেতিবাচক মনোভাব, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এক টেবিলে বসতে না পারা-রাজনীতিবিদদের অবস্থানকে দিন দিন তলানিতে নিয়ে গেছে। যার সুযোগ নিচ্ছে অন্য পেশার মানুষ এবং সুবিধাভোগী-সুযোগসন্ধানীরা।
এমনকি এর সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্র, কূটনীতিবিদ, দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বললে এসব বিষয় উঠে আসে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রবীণ রাজনীতিকরা মনে করেন, নেতারা যেদিন থেকে জনগণকে ছেড়ে দিয়েছে সেদিন থেকেই রাজনীতি তাদের হাতের বাইরে যেতে শুরু করেছে। তারা বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য যখন ভোটারের ভোট প্রয়োজন ছিল, তখন রাজনীতি নেতাদের হাতেই ছিল। কিন্তু যে সময় থেকে ভোটারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য মনোনয়নই মুখ্য হয়েছে তখন থেকেই রাজনীতি হাতছাড়া হয়েছে। এই সুযোগে অন্যরা নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে। এ দলে আছেন বিদেশি কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে আনতে হলে আগের মতো ভোটারদের কাছে যেতে হবে। তৃণমূলসহ সব পর্যায়ে জনতার সুখে-দুঃখে পাশে থাকতে হবে। নির্বাচিত হওয়ার জন্য অন্য কিছু নয় ভোটারকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন শনিবার বলেন, প্রকৃত রাজনীতিবিদরা হারিয়ে যাচ্ছেন। সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং নব্য ধনিক শ্রেণি রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়ায় প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখন অনেকটাই অসহায়।
তিনি আরও বলেন, সর্বত্র বিরাজনীতিকরণ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও এই চেষ্টা ছিল। স্বাধীনতার পরও এই বিরাজনীতিকরণের ধারা অব্যাহত আছে। আগের সামরিক সরকারগুলো এই কাজটি করত, এখন দলীয় সরকার করছে-পার্থক্য এটুকুই।
ড. কামাল হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলাদের বসানো হচ্ছে। প্রশাসন, সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমলাদের দাপট। এ অবস্থার কারণেও রাজনীতিবিদরা আজ কোণঠাসা।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ : (১ম থেকে ৫ম অধিবেশন)’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদে প্রকৃত রাজনীতিবিদ মাত্র ৫ শতাংশ। তাদের তথ্য অনুযায়ী সংসদে আইনজীবী ১৩, অন্যান্য (শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, গৃহিণী ও পরামর্শক ইত্যাদি) পেশার ২১ শতাংশ সদস্য রয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে সংসদে রাজনীতিবিদ ছিলেন ৮৫ শতাংশ। তবে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই সংসদে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে রাজনীতিবিদ সংসদ-সদস্যের হার ছিল ৫২ শতাংশ, ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ৪৯ শতাংশে। ২০০৮ সালে ৩৭ শতাংশ ছিলেন রাজনীতিবিদ। দশম জাতীয় সংসদে তা আরও কমে যায়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভাজন ক্রমেই সংঘাতে রূপ নিচ্ছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য শুভ নয়।
রাজনৈতিক সমস্যা হয় আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে, না হয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নিষ্পত্তি অথবা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এর সুদূর প্রভাবে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ক্ষতি হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশনির্ভরতা বাড়ছে। আমাদের দেশের দলগুলো জনগণের সমর্থনের চেয়ে বহির্বিশ্বের সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুদিন আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, রাজনীতি হয়ে গেছে গরিবের ‘বাউছ’ (ভাবিকে অনেক এলাকায় আঞ্চলিক ভাষায় ‘বাউছ’ বলা হয়)। গরিবের বউয়ের কাছে যেমন যে কোনো সময় যাওয়া যায়, তেমনি রাজনীতিতেও যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে যেতে পারে। এটি হতে পারে না।
রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারেও মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতি থেকে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা হারিয়ে যাচ্ছেন, যা তার মনঃকষ্টের বড় কারণ।’
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের স্মরণসভায় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের হাতে দেশের রাজনীতি নেই।’ সংসদেও তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। আমলাদের দাপটের কাছে রাজনীতিবিদরা ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি তখন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য দবিরুল ইসলামও সম্প্রতি সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডিসি (জেলা প্রশাসক), এসপিরা (পুলিশ সুপার) সংসদ-সদস্যদের কথা শোনেন না। সব ক্ষমতার মালিক তারাই। তাদের ইচ্ছাতেই সব হয়।’ এরও আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনীতিতে অন্য পেশার মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনে আইন করার দাবি জানান সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ পরিস্থিতিতেও থেমে নেই রাজনৈতিক তৎপরতা। জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল। ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনেরও দামামা বেজে উঠেছে। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে নির্বাচনের। সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন। নানা ইস্যুতে মাঠের রাজনীতি এখন চাঙ্গা।
আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। আওয়ামী লীগসহ তাদের শরিকরা সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিসহ তাদের শরিকরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার না হলে নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বসে নেই জাতীয় পার্টিও। নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
বাম প্রগতিশীল ঘরানার এবং ইসলামী দলগুলোও নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন পুরোমাত্রায় সরব ও সক্রিয়। তবে এই অবস্থানের মধ্যেও আরেকটি আলোচনা চলছে সর্বত্র, আর তা হচ্ছে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে এই মুহূর্তে কতটা রয়েছে।
বিশেষ করে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা এবং এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলোর ওপর নির্ভরতা, বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারস্ত হওয়া-এই প্রশ্নটিকে বারবার সামনে নিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। রাজনীতিবিদরা একসঙ্গে বসে সংকট সমাধান করবেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশের রাজনীতিবিদরা এক টেবিলে বসতে পারেন না। রাজনীতিবিদরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারেন না। যার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্র ও বিদেশি কূটনীতিকরা। তারা দেশের রাজনীতিতে হুটহাট নাক গলাচ্ছেন। কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কখনও ভারত, কখনও চীন, কখনও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ), আবার কখনও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ- যে যার মতো করে আমাদের গণতন্ত্র শেখানোর চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা অনেক আগেই পথ হারিয়েছেন। আমরা যে রাজনীতির কথা বলি, সেই রাজনীতির ‘নীতি’ হারিয়ে গেছে। এখন যা চলছে তা এক কথায় রাজচালাকি। নিজেদের সমস্যা নিজেরা বসে সমাধান না করে বিদেশিদের ডেকে আনছি। এরমধ্য দিয়ে আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারছি। একই সঙ্গে দেশটাকেও একটি অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। অথচ আমাদের একটি গৌরবময় অতীত আছে। আমরা পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিক এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা নাক গলান। মনে হয় রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। থাকলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
তিনি আরও বলেন, বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদদের অংশগ্রহণ নেই। করোনা মহামারি মোকাবিলার মূল দায়িত্বে ছিলেন আমলারা। রাজনীতিবিদরা ক্রমেই রাজনীতিতে অবহেলার পাত্র হয়ে উঠেছেন। আগে রাজনীতিবিদরা সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর এখন অন্যরা রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করেন। সময় এসেছে রাজনীতি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার। রাজপথে থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে রাজনীতিবিদরা যতটা জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেন, অন্যরা তা পারেন না। সে কারণেই রাজনীতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের হাতেই রাখতে হবে। নির্বাচনের জন্য অন্য কিছু নয় ভোটারের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এটা পারছি না বলেই দেশের রাজনীতি বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।