ঘূর্ণিঝড় ‘ড্যানিয়েল’র আঘাতের পর বন্যায় ভেসে গেছে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর ডেরনা। লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্টের তথ্য মতে, রোববারের এই আঘাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩০০তে। এখনো ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ। ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত। প্রায় এক লাখ মানুষের বাসস্থান ডেরনার কাছাকাছি শহর রক্ষা দুটি বাঁধের ফাটল থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বন্যার।
সংঘাত আর বিভাজনে অস্থির যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার অন্যান্য বিধ্বস্ত অবকাঠামোর মতোই অবহেলায় পড়ে ছিল এই দুটি বাঁধ। ১৯৯৮ সালে প্রথম ফাটল ধরা পড়লেও মেরামতের কাজ হাতে নিয়ে পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি কোনো কর্তৃপক্ষ। আর দুই দশকের এই অবহেলাই শেষপর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল লিবিয়ার। কেড়ে নিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। ১০ সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝড়সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পর থেকেই গত এক সপ্তাহ ধরে রাত-দিন উদ্ধার-তৎপরতা চালাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা।
বন্যার আগে প্রথমে ভেঙে পড়েছিল আবু মনসুর বাঁধ। এটি শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার (৯ মাইলেরও বেশি) দূরে অবস্থিত। পানির ধারণক্ষমতা ছিল ২২.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার (প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট)। পরপরই ভেঙে যায় আল বিলাদ নামের দ্বিতীয় বাঁধ। শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে এই বাঁধের পানি ধারণক্ষমতা ছিল ১.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার। ১৯৭০-এর দশকে দুটি বাঁধই নির্মাণ করেছিল একটি যুগোস্লাভ কোম্পানি। বাঁধ নির্মাণের আগে ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল ডেরনা।
রোববার লিবিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেল আল-সেদ্দিক আল-সৌর জানান, বাঁধ দুটি পানি সংগ্রহের জন্য নয় বরং বন্যা থেকে ডেরনাকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ফাটল দেখা দেওয়ার দুই বছর পর লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়নের জন্য একটি ইতালীয় প্রকৌশল সংস্থাকে নিয়োগ দিয়েছিল। বাঁধ দুটিতে ফাটল আছে বলে নিশ্চিত করে অন্য একটি বাঁধ নির্মাণের সুপারিশ করেছিল সংস্থটি। বাঁধ মেরামতে ২০০৭ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকার একটি তুর্কি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। তবে অর্থ প্রদানে সমস্যার কারণে কোম্পানিটি ২০১০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কাজ বন্ধ রেখেছিল। আর গাদ্দাফি পতন আন্দোলন শুরু হওয়ার পাঁচ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিবছরই দুটি বাঁধ মেরামতের একটি বাজেট বরাদ্দ করা হতো। দীর্ঘদিনের শাসক গাদ্দাফিকে হত্যা, গৃহযুদ্ধের পর ২০১১ সালে ন্যাটো সামরিক হস্তক্ষেপ করে দেশটিতে। আর এরপর থেকেই ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রশাসন।
২০১১ সালের পর থেকে পরবর্তী কোনো সরকারই এই কাজ হাতে নেয়নি। পুরোদমে বন্ধ ছিল মেরামতের কাজ। লিবিয়ার অডিট ব্যুরো ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে দুটি বাঁধের মেরামত কাজ ফের শুরু করার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের ‘বিলম্ব’র সমালোচনা করেছে। কর্তৃপক্ষ বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ না করলে ডেরনা একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে বলে এক বছর আগেই সতর্ক করেছিলেন দেশটির খ্যাতনামা প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ আবদেল ওয়ানিস আশুর। ২০২২ সালের নভেম্বরে একটি গবেষণায় বাঁধে ফাটলের বিষয়টি জরুরি পদক্ষেপের আওয়ায় নিতে বলেছিলেন সরকারকে। ভয়াবহ এ ঘটনার পর এখন সেই কথাই বলছেন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রধান পেটেরি তালাসও। জানিয়েছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে প্রাথমিক সতর্কতা ও জরুরি ব্যবস্থাপনা সঠিক হলে অনেক মৃত্যু এড়ানো যেত।