শক্তি পরীক্ষায় রাজনীতি এখন অন্দরমহল ছেড়ে মাঠে গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সরকারপন্থি এবং সরকারবিরোধী শিবিরের দলগুলো দাবি আদায়ে রাজপথকেই বেছে নিয়েছে। একদফার দাবিতে অনড় দুই পক্ষ। দুই পক্ষই হার্ডলাইনে। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অনড় অবস্থান অব্যাহত রাখতে চায় উভয় শিবির। এজন্য এক পক্ষ কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নামলে পালটা কর্মসূচি দেয় আরেক পক্ষ। কোনো অবস্থায়ই কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এমনকি সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনেও তারা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পাশাপাশি চলমান সহিংসতায় আতঙ্কও বিরাজ করছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাতে না যায়, এজন্য এখনই সমঝোতার পথ খুঁজতে বলছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করছেন, অন্যথায় দিনশেষে এই ভুলের খেসারত দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই, অতীত অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপি কিছুদিন ধরেই রাজপথে নানান কর্মসূচি দিয়ে সরব ও সক্রিয়। সরকারবিরোধী শিবিরের কর্মসূচির দিন শাসক দল বা তাদের শরিকরা একই দিনে নানা ইস্যুতে মাঠে থাকছে। আগামী দিনেও একইভাবে চলবে বলে আভাস মিলছে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কাও বাড়ছে। একই সঙ্গে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিও বাড়তে পারে। এসব নিয়ে শুধু স্থানীয় জনগণ বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক নন, বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন।
জানা যায়, যে কোনো মূল্যে সংবিধান মেনে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে অনড় শাসক দল। এই দাবিতে তাদের সঙ্গে আছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা, আছে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাকের পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামিক ফ্রন্ট, বিএনএ, সাত বাম দল, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টিসহ ডান-বাম ও ইসলামি ঘরানার আরও বেশকিছু রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ কখনো একা, কখনো তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে, আবার কখনো ১৪ দল জোটগতভাবে রাজপথে নানান কর্মসূচি পালন করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তারা ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার কথাও জানিয়েছে।
অপরদিকে বিএনপি বর্তমান সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে এখন পুরোদমে রাজপথে। দীর্ঘদিনের সুহৃদ জামায়াতে ইসলামীসহ গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যজোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরামের একাংশ, পিপলস পার্টি, লেবার পার্টিসহ সমমনা ৩৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে তারা এখন প্রায় প্রতিদিনই যুগপৎভাবে রাজপথে কর্মসূচি পালন করছে। একদফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি ও তাদের বলয়ে থাকা দলগুলো রাজপথ ছাড়বে না বলে জানান দিয়েছে। তারা মনে করছে, দাবি আদায়ের বিষয়টি রাজপথেই ফয়সালা হবে। তাই রাজপথে সরব এবং সক্রিয় থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প হাতে নেই।
অবশ্য আওয়ামী লীগ-বিএনপি বলয়ের এই মুখোমুখি অনড় অবস্থান দেশের জন্য এক অশনিসংকেত বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। দেশের ভবিষ্যৎকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন ব্যাহত হবে। কর্মসংস্থান বন্ধ হবে। আর্থিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। মানুষের জানমালেরই কেবল ক্ষতি হবে না, দিনশেষে রাজনীতিবিদরা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারলে খেসারত দিতে হবে দেশের জনগণকে। এমনকি রাজনীতিবিদদেরও এজন্য পস্তাতেও হবে, অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের পরিস্থিতি যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয় লক্ষণ ভালো না। আমার তো মনে হয়, নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসবে, এ ধরনের ঘটনা ততই বাড়তে থাকবে। দেশ ক্রমাগত সংঘাতের রাজনীতির দিকে ধাবিত হবে। তিনি আরও বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার থাকলে, গণতন্ত্রের চর্চা সীমিত হয়ে পড়লে, কিংবা দুর্বল গণতন্ত্র থাকলে রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে তখন সংঘাত। আমরা ক্রমান্বয়ে সেদিকেই ধাবিত হচ্ছি।
ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রধান চাওয়া যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা, না হয় ক্ষমতায় যাওয়া। এতে জনগণের কী লাভ হবে বা কী লাভ হচ্ছে, তা তারা ভাবেন না। তাদের ভাবনায় থাকে কেবল ক্ষমতা। আর এ কারণে আগামী কিছুদিন দেশের পরিস্থিতি অশান্ত থাকবে বলেই আমার ধারণা। তিনি বলেন, আলাপ-আলোচনা করে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমাদের রাজনীতিবিদরা সে পথেও হাঁটছেন না। আর আলোচনার টেবিলে না বসে রাজপথে নেমে সংঘাতের পথ বেছে নিলে পরে তাদের পস্তাতে হবে, অতীত অভিজ্ঞতা এমনটাই রয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। দুই বড় দল আলোচনার টেবিলে বসার বদলে রাজপথে ফয়সালা চাইছে। এতে সমস্যা কমবে না, বরং বাড়বে। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায় একটি পক্ষ। আরেকটি পক্ষ চায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই সমস্যা সমাধানে আলোচনায় বসা ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু কোনো পক্ষই আলোচনার টেবিলে বসতে নারাজ। তাহলে সমাধান কোন পথে হবে-রাজপথ সব সমস্যা সমাধানের জায়গা না। গত কয়েকদিন ঢাকাসহ সারা দেশে যা ঘটেছে, তা আরও বাড়তে থাকবে-এতে কারও লাভ হবে বলে মনে হয় না। জনগণ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরে বিরোধ-বিতর্ক-বিতণ্ডা ততই বাড়ছে। সমঝোতার বদলে মাঠের রাজনীতি ক্রমশ সংঘাতের দিকে গড়াচ্ছে। বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের চলাফেরাসহ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সর্বশেষ শনিবার ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপিসহ তাদের সমমনাদের অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে ওঠে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘাত-সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও এবং বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এদিন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি গণমাধ্যমকর্মীরাও আহত হচ্ছেন বিভিন্ন সময়।
রাজনীতির এই সংঘাতময় পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা আগেই ঘোষণা দিয়েছি যে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকব। আমরা শান্তি চাই। আমরা সংঘাত-সহিংসতা চাই না। একই সঙ্গে আমরা চাই সবাইকে নিয়ে দেশবাসীর সামনে একটি শান্তিপূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে। কিন্তু বিএনপি তা চায় না। বিএনপি যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ভন্ডুল করতে চায়। সাংবিধানিক ধারা ব্যাহত করতে চায়। নির্বাচন ভন্ডুলের নামে দেশে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। যার সর্বশেষ উদাহরণ শনিবারের ঘটনা। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচি পালনের নামে আগুন-সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে তারা তাদের সব অর্জন শেষ করে দিয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপি তাদের অতীত চরিত্রে ফেরত গেল-এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিএনপি যে সুস্থধারার রাজনীতি করতে পারে না, তাও প্রমাণ হলো।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের সঙ্গে থাকা কিছু সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দল বাদে সবাই গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একাট্টা। এই দাবিতে যে যার মতো করে এখন রাজপথে। সরকারি দল নিজেরা এবং তাদের সঙ্গে থাকা পুলিশ বাহিনী দিয়ে গণমানুষের আন্দোলন ঠেকাতে চাইছে। ফলে মাঠের রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে উঠছে। এর জন্য শতভাগ দায়ী আওয়ামী লীগ। তিনি আরও বলেন, সরকারি দলের উচিত গোঁ ধরে বসে না থেকে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নেওয়া। তা না হলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না, ঘরে ফিরব না।