সমবায় বাংলাদেশের সংবিধানে অর্থনীতির দ্বিতীয় ধাপ হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। দুর্নীতিবাজ একটি সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠান এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
বর্তমানে সমবায় সমিতিগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এসবের মূল কারণ সমবায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্মনিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্ত ও উপসচিব সিদ্ধার্থ শংকর কুন্ডু সিন্ডিকেটের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
ইতোমধ্যেই এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গ্রুপ তৈরিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ রয়েছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
কিন্তু এসব অভিযোগের পরও সমবায় অধিদপ্তর এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার। সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন) সিদ্ধার্থ শংকর কুন্ডু এবং সমবায় অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্তের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এসব অপকর্ম করে চলেছেন মৃণাল কান্তি।
তিনি তাদের দুজনকে নিয়মিত মাসোহারা দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে অদ্যাবধি অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অভিযোগেরই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জানতে চাইলে সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন) সিদ্ধার্থ শংকর কুন্ডু বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিয়ে থাকলে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং আমাকে হয়রানি করার জন্য এই ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালে অফিস সহকারী হিসাবে সমবায় অধিদপ্তরে চাকরি নেন বাবলা দাশ। ২০০৯ সালে পদোন্নতি পেয়ে উচ্চমান সহকারী হন। বর্তমানে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত বাবলার দাপটে তটস্থ থাকেন সবাই।
তার আশীর্বাদে পরিবারের ৫ জন চাকরি করেন সমবায় অধিদপ্তরে। যারাই তার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে যেখানে-সেখানে বদলি করে দেন। ইতোমধ্যে বাবলা দাশের সম্পদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, সমবায় অধিদপ্তরের ইপিপি ও গবেষণা শাখায় কর্মরত যুগ্মনিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
ঢাকা-গোপালগঞ্জে তার একাধিক ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। মৃণাল কান্তি সমবায় অধিদপ্তরের প্রশাসন, মাসউ ও ফাইন্যান্স শাখায় কর্মরত থাকাকালীন ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিবন্ধকের অনুমতি ছাড়া সমবায় অধিদপ্তরের শাটল সার্ভিসে ব্যবহৃত জিপ গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা থেকে রাজশাহী নিয়ে যান।
তিন দিন পর গাড়িটি সিরাজগঞ্জ জেলায় বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানাধীন ৯নং ব্রিজের আগে দুর্ঘটনায় পড়ে। এ সময় গাড়ির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। মৃণাল কান্তি বিশ্বাস তদন্তদলের কাছে তার অপরাধ স্বীকার করেন। এরপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, মৃণাল কান্তি বিশ্বাস টাঙ্গাইল জেলা সমবায় অফিসার থাকাকালীন টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের নিজস্ব শূন্য দশমিক ৮১ একর জায়গার ওপর একটি দ্বিতল মার্কেট ভবনে ১৫৫ জন ব্যবসায়ীকে মার্কেটের দোকান বরাদ্দ দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
দীর্ঘদিন ওই ১৫৫ জন ব্যবসায়ী বরাদ্দকৃত দোকানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকানির্বাহ করে আসছিলেন। তিনি টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের সভাপতি কুদরত-ই-এলাহী খানের সঙ্গে সখ্য করে পারস্পরিক যোগসাজশে সমবায় ব্যাংকের তহবিল তছরুপ করাসহ মার্কেট ভবন নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে সমবায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক টাঙ্গাইল থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়।
২০১৯ সালে মৃণাল কান্তি বিশ্বাস উপনিবন্ধক থেকে ১২ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে (সুপারসিড) করে যুগ্মনিবন্ধক পদ বাগিয়ে নেন। যুগ্মনিবন্ধক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর সমবায় অধিদপ্তরের প্রশাসনের পদে বসার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্ত।
১২ জনকে সুপারসিড করে অনৈতিকভাবে মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে পদোন্নতি প্রদান করায় সমবায় অধিদপ্তরের চেইন অব কমান্ড পুরোপুরি ভেঙে যায়। এসব বিষয়ে সেসময় বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হয়।
পরবর্তী সময়ে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে দপ্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয় এবং মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে সিলেট বিভাগে বদলি করা হয়। যুগ্মনিবন্ধক হিসাবে সিলেটের দায়িত্ব পালনকালে তিনি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলা সমবায় কার্যালয়ে কর্মরত সহকারী পরিদর্শক শুভাংশু চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে একজন মন্ত্রীর স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ একাধিক অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক মো. আমিনুল ইসলাম কর্তৃক স্মারক নং-৪৭.৬১.০০০০.০০৪.০৪.০২৮.১৯ জি (বিমা-০৫/১৯)- ৪১৪-এ/ও, তারিখ: ১০/০৩/২০২০ খ্রি. মূলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮-এর ৪(২)(গ) উপবিধি মোতাবেক তার বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত করে দণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু মৃণাল কান্তি বিশ্বাস সিলেট বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে যুগ্মনিবন্ধক থাকা অবস্থায় নিবন্ধকের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অভিযুক্ত সহকারী পরিদর্শক শুভাংশু চক্রবর্তীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে আদেশ নং-৭৫২, তারিখ: ০১/০৮/২০২১ খ্রি. মূলে তাকে উচ্চতর গ্রেড দিয়ে বেতন বৃদ্ধি করে দেন। যেখানে বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধিই স্থগিত, সেখানে উচ্চতর গ্রেড দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
সমবায় অধিদপ্তর তার আওতাধীন দপ্তরগুলোয় কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য ডেলিগেট করে দিয়েছে। কিন্তু মৃণাল কান্তি বিশ্বাস সিলেট বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে যুগ্মনিবন্ধক হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার নজর পড়ে উপনিবন্ধকের (বিচার) কার্যক্রমের ওপর। কারণ উপনিবন্ধকের (বিচার) দপ্তরে মামলায় পক্ষ-বিপক্ষ থাকে এবং পক্ষপাতমূলক রায় দিয়ে টাকা কামানোর সুযোগ রয়েছে। একপর্যায়ে তিনি উপনিবন্ধক (বিচার) মোহাম্মদ হাসিবুর রহমানের ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন এবং একই তারিখে দায়িত্বভার অর্পণ ও গ্রহণ করেন। দায়িত্বভার অর্পণ ও গ্রহণের ক্ষমতা শুধু নিবন্ধক ও মহাপরিচালক সংরক্ষণ করলেও তিনি তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
উপনিবন্ধকের (বিচার) ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তিনি মামলা গ্রহণ করতে থাকেন এবং একের পর এক পক্ষপাতমূলক রায় দিতে থাকেন। এমনও হয়েছে, তিনি উপনিবন্ধক (বিচার) হিসাবে একধরনের রায় দিয়েছেন, পরে আপিলাত কর্মকর্তা হিসাবে আবার ভিন্ন ধরনের রায়ও দিয়েছেন। সিলেটে যুগ্মনিবন্ধক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন তিনি গণহারে বদলি বাণিজ্য করেছেন। একজন কর্মচারীকে তিনি এক মাসের মধ্যে দুবারও বদলি করেছেন। অনেককে সংযুক্তির মাধ্যমেও বদলি দিয়েছেন। তার দায়িত্ব পালনকালীন সিলেটে যেই পরিমাণ বদলি বাণিজ্য হয়েছে, তা বাংলাদেশে আর কোথাও হয়নি বলে সিলেট বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্তব্য করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে মৃণাল কান্তি বিশ্বাসকে বারবার কল দিয়ে এবং মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ সিন্ডিকেটের বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেন কেউ সোচ্চার হতে না পারে, এজন্য সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভাগীয় মামলা, বদলিসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। বর্তমানে এসব কার্যক্রমের কারণে সমবায় অধিদপ্তরে এক ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কঠোর শাস্তির মাধ্যমেই এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে সমবায়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা সম্ভব।