– রিন্টু আনোয়ার
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠন পরিকল্পনা স্থগিত হওয়া এবং এর মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসন উন্নত করার প্রচেষ্টা, যা কর্মকর্তাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে, রাজস্বব্যবস্থার সংস্কারের জটিলতা তুলে ধরছে। জুনে বাজেট ঘোষণার আগে, মে মাস এনবিআর থাকে মহাব্যস্ত। বছরের বাকি ১১ মাসের চেয়ে সব চেয়ে বেশি কাজ হয় মে মাসে। প্রতিডিষ্ঠানটিকে ভাগ করা, আন্দোলন আর দলাদলিতে এবার মে মাস বরবাদ হয়ে গেছে । দিন কয়েক বাদেই প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। টাকা ছাপিয়ে অচল ব্যাংক সচল রাখার মতো সোজা কাজে যায়নি সরকার। টাকা ছাপিয়ে টসটসে বাজেট তৈরির কাজেও যায়নি। বাস্তব এবং বাস্তবায়নযোগ্য করতে গিয়েই এমন রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। বাংলাদেশে আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি। বড় গরমিল আছে আর্থিক খাতের নানা তথ্যেও। আর্থিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশও দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে দেশের ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে।
পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। ফলে এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকার ক্রাইসিস । কিছু ব্যাংক ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে বেশি মুনাফা দেখাচ্ছে। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে, আবার সরকারকে করও দিচ্ছে। আসলে ব্যাংকটির কোনো আয়ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগিতায় তারা পুষ্ট হয়েছে। এসবের যোগফলে এখন আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা । আবার যথানিয়মে যথাসময়ে বাজেটও দিতে হয়। বাজেট সামনে রেখে নানান দিক বিবেচনায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ- এনইসি সভায় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় সম্বলিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি- এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছে এটি শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের বাজেট। জানানো হয়েছে, বাজেটের জন্য টাতা তো সরকার ছাপাবেই না; আকার ছোট হলেও বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট করবে। বাজেট ব্যবস্থাপনাকে করবে টেকসই । রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করবে। জিডিপি ৪ শতাংশের নিচে রাখার চেষ্টাও করবে।
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে এমন প্রকল্প না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে আরো আগেই। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতও আনতে চায়। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরে দেশ থেকে পাচার হওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার সময়সাপেক্ষ। তারপরও বিদেশে কারা কোথায় অর্থ পাচার করেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা খুঁজে বের করছে। টাস্কফোর্স ইতোমধ্যেই এগুলো চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের কিছু ট্যাক্স হ্যাভেন (কর রেয়াত বা শূন্য কর) দেশে অর্থ পাচার হয়েছে। কিছু সংবেদনশীল মামলা ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।অভিযুক্ত পাচারকারীদের ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রক্রিয়া জড়িত। অর্থ পাচারকারীরা বোকা নয়, তাই সেগুলো উদ্ধার করা এত সহজও নয়। তারপরও সরকার আশা ছাড়ছে না। যদিও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নেই। তারওপর সময়টা বড় অস্থির। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তা কাটিয়ে ওঠার আগেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আরেকটি অর্থবছর। এ সময়ে বাজেট প্রণয়ন করা চ্যালেঞ্জ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কারের পথে থাকা এ সময়ে সবগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় না হয়ে পারে না। এর আগের যে তত্ত্বাবধায়ক আমল; কিংবা শেখ হাসিনার শাসনামলের যে বাস্তবতা, তার সঙ্গে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারকে মেলানো যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে আগামী বাজেট নিয়ে নানা সময়ে বলা হয়েছে, চড়া মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির বোঝা নিয়েও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে উচ্চাভিলাসী বাজেট দিয়ে আসছিল, তারা সে পথে হাঁটতে চান না। তবে উচ্চাভিলাসী বাজেট থেকে চোখ সরালেও রাজস্ব ঘাটতি কমানো কিংবা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় অস্বীকার করাও যাচ্ছে না। আবার কাটছাঁটের ব্যাপকতাও কাম্য নয়।
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটলে ক্ষমতায় আসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারে বসার পর থেকেই নানা দাবি-দাওয়ায় প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরির পাশাপাশি গত কয়েক মাসে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হতে থাকে। রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে ভাটা দেখা যায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও। বেড়েছে বেকারত্বের হারও। এর মাঝেই দিতে হচ্ছে বাজেট। আর বাজেটে মূলত সরকারের এক অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ও অর্থনীতির গতিপথ বাতলে দেওয়ার রূপরেখা ও নকশা থাকে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেলে দিশা। সরকারের আয়-ব্যয়ের ঘাটতির জোগান কীভাবে হবে, তার একটা ধারণাও থাকে বাজেটে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কিছু সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপ, বড় ধরনের বৈদেশিক ঋণ মেটানোর দায়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, কিন্তু করজাল বাড়ানোর মতো কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ যথেষ্ট দৃশ্যমান নয়। প্রতি অর্থবছরেই দেখা যায়, অর্থের সংকুলান না হলেও উচ্চাভিলাসী বাজেট করা হয়েছে। এবার আশাটা পূরণ হবে বলে শোনানো হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে পড়ার মধ্যে ‘বাস্তবায়নযোগ্য’ বাজেট কেমন হতে পারে-তা এখনো পরিস্কার নয়। অর্থের সংকুলান করতে গেলে দেশজ পণ্য উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমবে। তা এরইমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগীরা পূর্বাভাসে বলেছে। তারা আসছে অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের আশপাশে থাকবে বলে সতর্ক করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা, বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকার বিষয় রয়েছে। এখন অনেকে বলছেন, এটা ৫ শতাংশের নিচে থাকবে। তো এখন জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি কম হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। কর্মসংস্থান না হলে দারিদ্র বিমোচনে আমরা হোঁচট খাবে। অর্থসামর্থের বাইরে বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা জরুরি। বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করারও আরেকটি জরুরি বিষয়। কর না বাড়িয়ে কর ফাঁকি ধরা গেলেও কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে বলেছেন, এবারের বাজেটে প্রত্যাশার ফুলঝুড়ি থাকবে না। জনমনে প্রশ্ন আছে, দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা থাকবে তো?
বলার অপেক্ষা নেই, গেল সরকার দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের অভাবে দেশকে গভীর সংকটে ফেলে পালিয়েছে। যার বোঝা এখন দেশকে টানতে হচ্ছে। দেশ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা, বিনিয়োগের নিম্নহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা, ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক ঋণ পরিষেবার চাপ বৃদ্ধি এবং সরকারি অর্থের অদক্ষ ব্যবহারের মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজস্ব আহরণ শক্তিশালী করা, যা সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। এক দশক ধরে রাজস্ব আহরণের নিম্নহার থাকায় ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির পরিকল্পনা অবাস্তব মনে হচ্ছে। সরকারের উচিত করহার বৃদ্ধি না করে করভিত্তি সম্প্রসারণ, সঠিকতা নিশ্চিতকরণ এবং করব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে কর নেটের আওতায় আনা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি শুনতে কান সুখ পায়। স্বাভাবিকভাবেই বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ এখনো মোট জিডিপির ১ শতাংশের নিচে রয়েছে, যা কয়েক দশক ধরে অপরিবর্তিত আছে। একইভাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দও জিডিপির ২ শতাংশের মতো, যা মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। তা কিন্তু ভালো বার্তা দিচ্ছে না। এ ছাড়া, এমনিতেই নির্বাচন, সংস্কার, নয়া নয়া দলের আবির্ভাবে রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। নিত্যপণ্য বলতে যারা কেবল চাল-ডাল-তেল- আলু পিঁয়াজ বোঝেন, তাদের কথা আলাদা। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির একটা তৃপ্তি আছে। রিজার্ভ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ভালো খবরও আছে। কিন্তু, বিনিয়োগে স্তব্ধতা ও বিজনেস হাউসগুলোর উদ্বেগ অর্থনীতির সংকটকে এক চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিছু সূচকে উন্নতির আভাস থাকলেও অর্থনীতির অন্দরমহলে চলছে রক্তক্ষরণ। ২১ বিলিয়ন রিজার্ভের বিপরীতে শতাধিক বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ। রাজস্বের অর্ধেক টাকা চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ শোধে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে নজর না দেয়ার পরিণতি কী হয়, তার উজ্জ্বল নজির বাংলাদেশ।
বিশ্ববাজারে দৃষ্টি রাখা দেশ, প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট দুনিয়া কোনো দেশের অর্থনীতি বুঝতে বিশেষ চাহনি দেয় পূঁজিবাজারের দিকে। বাংলাদেশ সেখানেও বড় দুর্ভাগা। পুঁজিবাজারে দীর্ঘতম মন্দার রেকর্ডে আক্রান্ত বাংলাদেশ। নিত্যপণ্যের বাজারব্যবস্থাপনায় আবার ব্যঘাতের নমুনা স্পষ্ট। মাঝে রমজানের পূর্বাপরে কয়েক দিন দ্রব্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণরেখার দিকে আসতে থাকলেও বর্তমানে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। একইসঙ্গে, বেকারত্ব বাড়ছে তো বাড়ছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনে ব্যাঘাতের কারণে নতুন নিয়োগ বন্ধ। সময় মতো বেতন হচ্ছে না বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। কোথাও কোথাও ছাঁটাই চলমান। মানে পুরনো বেকারের সঙ্গে নয়া বেকার যোগ। অর্থনীতির সঙ্গে সামাজিকতার জন্যও তা লাল সংকেত।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট