• শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫২ পূর্বাহ্ন

অসংখ্য যুবকের কোটি কোটি টাকা চাকরি দেওয়ার নামে লোপাট স্বামী-স্ত্রীর

Reporter Name / ২৮ Time View
Update : বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার হাট বসিয়েছিলেন লাজলী আক্তার লাবণ্য। তিনি নিজেকে যুব মহিলা লীগ নেত্রী এবং তার স্বামী আনসার সদস্য ফরিদ নিজেকে র‌্যাবের বড় কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। তারা নিজেদের পিএস-এপিএস নিয়োগ দিয়ে সাধারণ যুবকদের বিভ্রান্ত করেছেন।

বিভিন্ন স্থান থেকে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতারণার একটি ফাঁদ তৈরি করেছেন। এই ফাঁদে পা দিয়ে অসংখ্য যুবক সর্বস্ব খুইয়েছেন। এরা (স্বামী-স্ত্রী) চাকরির ভুয়া নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে লুটে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। বিগত সরকারের আমলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে বেশ কয়েকটি অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের প্রতারণার ডালপালা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যতদূর মনে পড়ে এই সিন্ডিকেটকে সমূলে নির্মুল করতে সিআইডি পুলিশকে মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলাম।

কিন্তু বিগত সরকারের সময়ে মানি লন্ডারিংয়ের পরিবর্তে গতানুগতিক ধারায় মামলার চার্জশিট দেয় থানা পুলিশ। কিন্তু এসব মামলা জামিনযোগ্য। চার্জশিট হওয়ার পরও আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আবারও প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েন। যে কারণে তাদের প্রতারণার সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি।

তিনি বলেন, এরা বহু সাধারণ পরিবারের যুবককে পথে বসিয়েছেন। চাকরির নাম করে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে যদি একটি পরিবার থেকে ৮ বা ১০ লাখ টাকা নিয়ে যায় তাহলে ওই পরিবারই তো নিঃস্ব হয়ে যাবে। এ কারণে গতানুগতিক মামলা বাদ দিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় মামলা দেওয়া উচিত ছিল। এই ধারায় মামলা দেওয়ার এখতিয়ার শুধু সিআইডির।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হলে আদালত একটা পর্যায়ে মালামাল ক্রোকের আদেশ দেন। তখন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এভাবেই এরা সর্বস্বান্ত হলে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে বলে মনে করেন পুলিশের এই সিনিয়র কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বামী-স্ত্রী লাজনী ও ফরিদই শুধু নয়, এদের সঙ্গে আছে আরও কয়েকজন। আনসার সদস্য ফরিদ র‌্যাবে প্রেষণে ছিলেন। এই সুযোগে তিনি র‌্যাবের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বেকার যুবকদের প্রলুব্ধ করতেন। অল্প শিক্ষিত বেকার ছেলেদের সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য যুবককে এরা পথে বসিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পদ নিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, লাবণ্যর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাউজিং এস্টেটে। তার পিতার নাম শুকুর চৌধুরী। ঢাকার মিরপুরে ১-এর ১নং রোডের ৯-ডি প্লটের ১নং বাড়িতে থাকেন। তার স্বামীর নাম ফরিদ উদ্দিন। তিনি আনসারের সদস্য। প্রেষণে র‌্যাবে কর্মরত। এক মেয়ের স্বামী ফয়সাল আহম্মেদও এই চক্রের সদস্য। গ্রামের সাধারণ ছেলেদের টার্গেট করে এই চক্র প্রথমে ফোন করে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।

এ সময় আগ্রহ না দেখালে অপর প্রাপ্ত থেকে র‌্যাবের পোশাক পরা ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে বিশ্বস্ততা অর্জনের কৌশল নেয়। এ অবস্থায় অনেক যুবক বিভ্রান্তিতে পড়ে রাজি হন। একপর্যায়ে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলে তারা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। চাকরি না হলে টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়েও গ্যারান্টি দেন।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার ডেফলচড়া গ্রামের ষষ্ঠীনাথ সেনের ছেলে মানিক কুমার সেন ও তার বড় ভাই মোহন সেন ভুক্তভোগী। এর মধ্যে মানিক বর্তমানে টঙ্গীর কামারপাড়ায় সদাগর কুরিয়ার সার্ভিসে আইটি এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত। চক্রটি এই দুই ভাইয়ের কাছ থেকেই ২২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানিক বলেন, ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল মিরপুর মডেল থানায় প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় লাবণ্য, তার স্বামী ফরিদ উদ্দিন, মেয়ে জামাই সৈকত, তার বন্ধু রাশিদুল ও সিন্ডিকেট সদস্য মিজানুর রহমানকে আসামি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, মামলার আসামিরা সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নামে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রতারণা করে।

একই এলাকার রাশিদুল ইসলাম নামে তার এক বন্ধু ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রথমে সে রাজি হয়নি। পরে চাকরি হওয়ার পর টাকা দেওয়ার কথা বলে। এই প্রস্তাবে রাজি হয় মানিক। এভাবে চাকরির বিনিময়ে ১১ লাখ টাকায় দফারফা হয়। ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর আকস্মিক তার মৌখিক পরীক্ষার তারিখ দেওয়া হয়। তাও মুখে মুখে। তাদের কথামতো ওইদিন সচিবালয়ের গেটে যায় মানিক। কিছুক্ষণ পর অজ্ঞাতনামা একজন ব্যক্তি তাকে সচিবালয়ের ভেতরে লাইব্রেরি রুমে নিয়ে যায়। এরপর ওই ব্যক্তিই তার ইন্টারভিউ নেয়। তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করেন তিনি।

এরপর যে পদে চাকরি দেওয়ার কথা সেই পদ-পদবি ও তার ছবি সংযুক্ত করে একটি নিয়োগপত্র দেখিয়ে ছবি তোলার সুযোগ দেন ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি। তিনি যুব মহিলা লীগ নেত্রী লাবণ্যের বাসায় গিয়ে ১১ লাখ টাকা দিতে বলেন। এরপর তার বাবা ও ভাই মিরপুরের বাসায় গিয়ে ১১ লাখ টাকার মধ্যে ৬ লাখ টাকা দিয়ে আসেন। ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যেই চাকরির নিয়োগপত্র বাড়ির ঠিকানায় ডাকে পাঠানোর কথা বলেন। প্রতারণার এই ফাঁদে পা দিয়ে এই চক্রের সদস্য তার বন্ধু রাশিদুলের কাছে আরও ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন মানিক।

ভুয়া নিয়োগপত্র গ্রামের বাড়িতে আসার আগেই টাকা তুলে নেওয়া হয়। ৩০ অক্টোবর লাবণ্যের মিরপুরের বাসায় আসেন মানিকসহ তার বড় ভাই মোহন সেন। ওই সময় তার বড় ভাইকেও খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেয়। উপ-খাদ্য পরিদর্শক পদে চাকরির জন্য ১৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ভুয়া নিয়োগপত্র ডাকে পৌঁছার আগেই খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরির জন্য নেয় আরও ১১ লাখ। সরকারি চাকরির প্রলোভন দিয়ে এভাবে এই পরিবারের কাছ থেকেই হাতিয়ে নেওয়া হয় ২২ লাখ টাকা। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে প্রতারক চক্রকে টাকা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন তারা।

২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল মানিকের এই মামলার চার্জশিট দেয় পুলিশ। চার্জশিটে এসব প্রতারকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলার তথ্য তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় ২টি (২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দায়ের করা মামলা নং ৩১ ওপিটিশন মামলা নং ২২৪/২২)।

এছাড়া ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মিরপুর মডেল থানার মামলা নং জিআর ২৬৮/২০, ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর খুলনার সদর থানার এফআইআর নং ১১/২৬৮, একই তারিখে খুলনা সদর থানার জিআর নং ২৬৮, খুলনার খানজাহান আলী থানার সিআর মামলা নং ৫৮/২০২০, খুলনার দৌলতপুর থানার মামলা নং ১৭৭/২০২০। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন থানায় এদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মোবাইল নাম্বার বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category