• বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:২১ পূর্বাহ্ন

আশুরা নিয়ে বাড়াবাড়ি ও কুসংস্কার

Reporter Name / ১০৯ Time View
Update : শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫

-রিন্টু আনোয়ার

‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –
জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?
হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়
উন্ মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়
আলীজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়…..।’
কাজী নজরুল ইসলামের তার অমর ‘মোহর্‌রম’ কবিতায় আশুরার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছিলেন এভাবেই। নজরুল আশুরার দিন নিয়ে লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি কবিতা।
বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন আশুরার দিনে কারবালার প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ নামে গোটা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রায় ১৪০ বছর আগে লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে কারবালার যুদ্ধকে বাংলা সাহিত্যেও অমর করে গেছেন মীর মোশাররফ হোসেইন। বাংলা সাহিত্যেও কারবালার বিয়োগাত্মক ঘটনা নিয়ে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। তাই ১০ই মহররম বা আশুরার দিনটি বাংলার লোক সংস্কৃতিতে এক অনন্য জায়গা দখল করে আছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে যুক্ত আর কোনো ঘটনা লোক সাংস্কৃতিতে এতটা গুরুত্ব পায়নি। বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গেই যেন ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে মহররম।
মহররম হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামে এ মাসের সঙ্গে অনেক ঘটনার স্মৃতি জড়িত। এসব স্মৃতির সম্মানার্থে এ মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে নামকরণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত’। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের সুরা বাকারার ১৮৯ আয়াতে হিজরি সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন: লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের হিসাব এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য।
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ১০। মহররম মাসের ১০ম দিনকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ ৬২ হিজরি সনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং জান্নাতে স্থান দিয়েছেন। এই দিনে নূহ (আ.)-এর কিস্তি প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
পুরান ঢাকায় আশুরা পালনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। মোগল আমল থেকেই এর সূচনা। মোগলরাই শিয়া মতাবলম্বীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। বিখ্যাত মোগল শাহজাদা শাহ সুজা বাংলার সুবেদার হয়েছিলেন ১৬১৬ সালে। শাহ সুজা শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় সাড়ে তিন শ শিয়া পরিবারকে ঢাকায় এনেছিলেন শাহ সুজা। ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ইমামবাড়া হোসেনী দালান নির্মিত হয়েছিল শাহ সুজার সুবেদারির সময়েই। শাহ সুজা তার নৌ সেনাপতি সৈয়দ মীর মুরাদকে দিয়ে ইমাম হোসেনের স্মরণে নির্মাণ করেছিলেন হসেনি দালাল। ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া হোসেনী দালানের ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সেটি ছিল ছোট আকারের ইমামবাড়া। এটি পরে ভেঙে গেলে নায়েব নাজিমরা নতুন করে ইমামবাড়া নির্মাণ করেন।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন জেমস টেলর তার লেখা ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছিলেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুই দফা সংস্কার করলেও পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে তা বিধ্বস্ত হয়। যদিও লক্ষাধিক টাকা খরচ করে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেছিলেন ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ। শিয়া মতাবলম্বীরা এই ইমামবাড়া ও আশুরা পালনকে টিকিয়ে রাখেন। তেমনই আশুরা পালনের আরেকটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের ‘বিবিকা রওজা’। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন ইমামবাড়া।
আশুরার দিনটি যেমন ধর্মীয়ভাবে গাম্ভীর্যপূর্ণ তেমনইভাবে বাংলার লোক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বহুক্ষেত্রেই বাংলার লোক সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তেমনই এক অনন্য উদাহরণ আশুরা।
আশুরা মানেই কারবালা নয়। আশুরার মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই স্বীকৃত। ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে নবীজি (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ আশুরার সঙ্গে মিলে যাওয়া কাকতালীয়। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির লোকের শোক প্রকাশের অযৌক্তিক নানা আয়োজনের কারণে আশুরা ও কারবালাকে একাকার মনে করে থাকেন অনেকে। তাই তারা নানাভাবে এ দিনটি পালন করে এসেছেন সেই প্রাচীনকাল থেকে।  কারবালার শোকাবহ বিয়োগান্ত ঘটনাকে স্মরণ করে। মহররমের চাঁদ দেখা যাওয়ার পরপরই ঢাকায় শিয়া মুসলমানরা ইমামবাড়াগুলোতে দশ-বারো দিনব্যাপী শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পুরান ঢাকার হোসেনি দালান, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, ফরাসগঞ্জের বিবিকা রওজা, পল্টনের ইমামবাড়ি, মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ ইত্যাদি স্থানে শোক মজলিসের আয়োজন করা হয়। এ সকল মজলিসে আলেমরা ইমাম হুসাইনের বিপ্লবের কারণ, তার বিভিন্ন বক্তব্য, তার শাহাদতের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পাশাপাশি বর্তমান সময়ের সঙ্গে ইমাম হুসাইনের সময়কালের সাদৃশ্য, বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর করণীয় ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য রাখেন। এরপর মর্সিয়া পাঠ করা হয় এবং ইমামবাড়াগুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। শোকার্ত জনতা শোকের নিদর্শন হিসেবে কালো কাপড় পরে একে অপরকে শোক জ্ঞাপন করেন। পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে, রাস্তায় সড়কে ও বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও অন্য কিছু স্থানে ইমাম হুসাইনের বার্তাবাহকের প্রতীক হিসেবে ‘কাসেদ’দের গায়ের সঙ্গে মোটা সাদা-কালো সুতলির মধ্যে ঘণ্টি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ফলে হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে আশুরা নিয়ে অনেক সময় বেশ বাড়াবাড়ি দেখা যায়। আছে অনেক কুসংস্কারও। অন্যতম একটি হলো মাতম মর্সিয়া গাওয়া। মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা ও জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। নবী করিম (সা.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হা-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২৯৭)
কারবালার শোকাবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে মহররম ও আশুরা পালন নিয়ে প্রতি বছর কিছু বাড়াবাড়ি হয় যা মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের অতিরিক্ত আবেগ বা আচরণের বহিঃপ্রকাশ। আর এই শোকের বহিঃপ্রকাশের নামে বাড়াবাড়ি আচার-অনুষ্ঠানে যদি কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তা কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category