-রিন্টু আনোয়ার
কেবল তারিখ ঘোষণা ছাড়া নির্বাচনের যাবতীয় আয়োজন শেষ প্রায়। ফেব্রুয়ারিতেই নয়, মধ্য ফেব্রুয়ারিতেও নয়;ভোট হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রোজার আগে। কথা একদম লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। এ রকম একটা অবস্থায়ও মাঠেঘাটে প্রশ্নের তীর, নির্বাচন আসলে হবে তো? কী জবাব হতে পারে এ প্রশ্নের? আর প্রশ্ন আসছেই বা কেন? কোন কারণে তা জানতে চাওয়া? নিশ্চয়ই খামাখা নয়। কিছু প্রেক্ষিত ও নমুনা তো আছেই। সেটাকে বলে সংশয়, অবিশ্বাস, অনাস্থা।
মাঠের চিত্রেও কিছুটা ভিন্নতা চলছে, যা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। ফেব্রয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উচ্ছ্বাসের সাথে অন্য দলগুলোর মতিগতির মাঝে কিছুটা ব্যাতিক্রম লক্ষনীয়। জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি দল প্রতিক্রিয়ার মাঝে ‘যদি-কিন্তু-তবে’ দিয়ে কিছু বাড়তি কথা যোগ করছে। সংস্কার, বিচার, পিআর, জুলাই সনদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বেশ কিছু বাড়তি কথা রয়েছে। তবে নির্বাচনে যাবে না ধরনের কথা এখনো বলেনি। কিন্তু, বাড়তি এবং আকস্মিক কথা একটার প্রকাশ ঘটিয়েছেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড.ইউনূস। তিনি করেছেন সতর্ক। বলেছেন, কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প ভাবের তবে, দেশ ঝুকিতে পড়ে যাবে। ম্যাসেজ এবং সতর্কটা হিসেবে এটি মারাত্মক। প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে নির্বাচনের বিকল্প ভাবনাটা এলো কোত্থেকে? কারা ভাবছে এ বিকল্প ভাবনা? প্রধান উপদেষ্টা মনগড়া বা এমনি এমনি সতর্কতা জারি করার কথা নয়।
তার কেন জানাতে হলো নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবলে তা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। তাও বলেছেন, সময় ও জায়গা মতো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের ব্রিফিংয়ের মাধ্যমেও জানানো হয় তার এ মন্তব্য ও উপলব্ধির কথা। প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে সময় ঘোষণা করেছেন, নির্বাচন সেই সময়ের মধ্যে হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব রাজনৈতিক দলকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে আবারও তার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছেন। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে, নির্বাচনের বিকল্প গেল আমলে খোঁজা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারই বার বার দরকার, গণতন্ত্র বা নির্বাচনের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি-এমন বার্তার মাধ্যমে টোকা দেয়া হয়েছে। এতো টাকা খরচ করে নির্বাচনের কী দরকার? ক্ষমতায় তো শেখ হাসিনাই থাকবেন- এমন হাইপ তোলার চেষ্টাও চলে। নমুনা বুঝে কেউ কেউ কোরিয়া মডেল নির্বাচনী আয়োজনের মন্ত্রও দিতে থাকেন। কিন্তু, গেলানো যায়নি। তাই নির্বাচনের বিকল্প হিসেবে দিনের ভোট রাতে, বিনাভোটে ১৫৪ জনকে বিজয়ী করে দেওয়া, ডামি-আমি তামাশা করা হয়। যা প্রকারান্তরে দেশকে মহাসংকটে ফেলে। শেখ হাসিনার নির্মম পতনও নিশ্চিত হয়।
কিছু শঙ্কা-ভয় ও লক্ষণ দেখলে যে কোনো সরকারকেই অনেক কিছু ভাবতে হয়। এ মাসের শেষ সপ্তাহে দুর্গাপূজা শুরু। দুর্গাপূজা ঘিরে যেন দেশে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র, কেউ যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে দেশের কোথাও যাতে অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে মাঠ প্রশাসনকে কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিবারই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে একটি চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপচেষ্টা করে থাকে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে নির্বাচন ছাড়াও রয়েছে সংস্কার, বিচার, জুলাই সনদ। এগুলোর একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সাংঘর্ষিক বা বিকল্পও নয়। এরইমধ্যে প্রধান দায়িত্বের মধ্যে চলে এসেছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত নির্বাচন কমিশন। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নানান তবে-কিন্তু-যদি যোগ করলেও জামায়াতে ইসলামী বরং প্রস্তুতিতে বেশি এগিয়ে। ৩’শ আসনে সবার আগে প্রার্থী ঠিক করেছে তারা। দিয়েছে বেশ কিছু ঘোষণাও। পর্দার আড়ালে গভীর ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের সন্দেহও ব্যাপক। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-পিআর, ‘জুলাই সনদ’-এর সাংবিধানিকীকরণ এবং গণপরিষদ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যাপক গোলমাল। এ দাবিগুলো দৃশ্যত গণতান্ত্রিক বা সংস্কারমূলক শোনালেও গভীরে ভিন্ন কিছুর আলামত। মানে নির্বাচনকে নির্দিষ্ট সময়ে হতে না দেওয়া।
এ রকম সময়েই আসলো প্রধান উপদেষ্টার সতর্কতাটি। এরইমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো নিয়ে তোড়জোর শুরু হলেও এতে মারাত্মক ছেদ পড়েছে। নানান কাণ্ডকীর্তিও ঘটছে। জাতীয় রাজনীতির ভেতরের অবস্থাও স্বচ্ছ নয়। নানা ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে। লুকানোর আর জায়গা নেই, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দুটি প্রধান ধারা স্পষ্ট। একদিকে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা কয়েকটি দল। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন প্রত্যাশী। জামায়াত-এনসিপির বন্ধনও খোলাসা। এই পরিস্থতিতে দেশকে একটি সুন্দর নির্বাচন দেয়ার প্রত্যয় প্রধান উপদেষ্টার। বারবার বলেছেন, এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ওয়ান অব দ্য বেস্ট ইলেকশন হবে। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসিরউদ্দীনের আশা একটি চমৎকার নির্বাচন দিয়ে জীবনের শেষ কাজটি করার। টানা তিন মেয়াদে শেখ হাসিনার নির্বাচনী তামাশায় মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। এখন একটি সম্ভাব্য সুন্দর নির্বাচনের প্রাক্কালে এসে বেশি কচলানি প্রত্যাশিত নয়। তার চেয়ে নির্বাচনটিকে আরো কতো সুন্দর-সুষ্ঠু করা যায়-সেই আলোচনা বেশি হওয়া উচিৎ।
নির্বাচনের প্রস্তুতি ঠিক মতো চলছে কিনা, সেদিকেও দৃষ্টিপাত এবং প্রয়োজনে সমালোচনা দরকার। নির্বাচনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের কর্মযজ্ঞের খবর মানুষ নিয়মিত দেখছে। প্রশাসনকেও সাজানো হচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে আরপিও সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনা। কোনো আসামিকে আদালত পলাতক ঘোষণা করলে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, এমন বিধান আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে ইসি। সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধানও বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সাংবিধানিক এই সংস্থা। এ দুটিসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আরও বেশ কিছু সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে ইসি। গত মঙ্গলবার ইসির প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে সশস্ত্র বাহিনীকে সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়েছে। এতে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা ভোটকেন্দ্রে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন। এ ছাড়া কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখা, ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো, জামানতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা, প্রার্থীর হলফনামায় দেশ ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব আছে। এর আগে গত ১১ আগস্ট আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল ইসি। তখন পলাতক আসামিকে অযোগ্য করার বিধানটি ইসির প্রস্তাবে ছিল না। পরে এটি যুক্ত করা হয়। সবমিলিয়ে প্রস্তুতি ও আয়োজন যথেষ্ট।
নির্বাচনের আগে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) তুলে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মাঠ প্রশাসনের ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে তাকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তও রয়েছে। সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাজানোর কাজও চলছে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মাঠের সর্বশেষ পরিস্থিতির আপডেট নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে, বিতাড়িত-পতিত শক্তির আয়োজনে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা বাধানোর কানাঘুষা বেশ জোরদার। এর কিছু আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। এরমধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের উপর হামলা, শিক্ষাঙ্গণে অস্থিরতা তৈরী, শ্রমিক অসন্তোষের ষড়যন্ত্র দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। সেটিও উদ্বেগের একটি কারণ। এটি অশনি সঙ্কেত। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ছাত্ররাই প্রভাবিত করতে পারে রাজনীতিকে। এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়তো, তারচেয়ে এখন অনেক বেশি পড়বে। কারণ এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির বীজটা ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রদের মুভমেন্ট থেকে আসা। যার ফলাফল খুব ভাল কিছু হবে না। ডাকসু- রাকসু বা চাকসু নির্বাচন নিয়ে বেশ অস্থিরতা চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলোকে একেবারে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা যায় না। শুধু শিক্ষাঙ্গণই নয় দেশের বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায়ও শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে অস্থির পরিস্থিতি তৈরীর চেষ্টা চলছে।
গণ-অভ্যুত্থানে শরিক সব রাজনৈতিক দলের এখন উচিত হবে ফেব্রুয়ারি’২৬–এর নির্বাচনকে দলীয় স্বার্থের ওপরে জায়গা দেওয়া। নির্বাচনটিকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করে এ ক্ষেত্রে সব অনিশ্চয়তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া।
নিজেদের ভবিষ্যতের ক্ষমতাসীন দল বিবেচনা করে গণতান্ত্রিক সংস্কারে ছাড় না দেওয়া বা কোনো একটি দলের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে ফেলা—দুটি পথই আত্মঘাতী। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ হিসাব করতে হবে যে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মুখে পড়লে আসলে কার লাভ? নির্বাচনী ট্রেন ছুটে চলার মাঝে এসব ঘটনা শঙ্কায় বেশ টোকা দিচ্ছে।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট