• বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:০০ পূর্বাহ্ন

স্পর্শকাতর করিডর:  অতিকথন কাম্য নয়

Reporter Name / ৫০ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫

-রিন্টু আনোয়ার

বাংলাদেশের কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর স্থাপন নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে করিডর দেওয়ায় আপত্তি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো।
এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিসংঘের করিডর দেওয়া নিয়ে যে গুজব উঠেছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিচ্ছি, করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনও কথা হয়নি, কারও সঙ্গে কথা হবে না। সেখানে আপডেট ভার্সনে তিনি মানবিক করিডর কাকে বলে সেটাও বুঝিয়েছেন। তার মানে আপডেটে কি কথায়ও গোলমাল? যদি দেয়াই না হয়ে থাকে, তাহলে এ নিয়ে এতো কথা কেন?
করিডর নিয়ে প্রকারান্তরে গোলমালটা সরকারের কয়েক উপদেষ্টারই তৈরি করা। একেকবার একেক কথায় তারা ভেজাল বাঁধিয়েছেন। একবার জানালেন রাখাইন রাজ্যে করিডর দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরেকবার বললেন , সিদ্ধান্ত নয় আলোচনা হয়েছে। এখন বলছেন, না কোনো আলোচনাই হয়নি। আবার জাতিসংঘের দোহাই টানা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে এ ধরনের মন্তব্যে ও অতিকথনে দেশে এবং রাজনীতিতে কী কাউর বাঁধছে উপদেষ্টাদের  গায়ে তা লাগছে না? না-কি তাপবোধই নেই তাদের?  নইলে কেন পরক্ষণে আবার যোগ করলেন, মানবিক সহায়তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে জাতিসংঘের কাছে, বাংলাদেশের কাজ হবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা। কী মানে দাঁড়ায় এ ধরনের চতুরঙ্গি কথার? তারপরও বলার স্বাধীনতা নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানসহ উপদেষ্টাদের একটু বেশিই আছে।  সেই অধিকার তারা আরো পোক্ত  করেছেন। মানবিক সহায়তা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো মতপার্থক্য আছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে এ বিষয়ে তার বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই। পুরোটাই গুজব।
মিয়ানমারের ৯০ শতাংশ এলাকা বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সে কারণে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা চলছে।
এখন পর্যন্ত ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, এই সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তারপর থেকে এই ইস্যুটিকে আমরা আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় পুনরায় তুলে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এর আগে সাত বছর এই ইস্যুটি প্রায় অপসৃত হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক গাজা এবং ইউক্রেন ইস্যুতে রোহিঙ্গা ইস্যু আরও পেছনে পড়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এটি উত্থাপন করেছিলেন এবং জাতিসংঘকে এই ইস্যুতে একটি সম্মেলন আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে সাড়া দিয়েছে।একটি জাতি নিয়ে জাতিসংঘের এমন সম্মেলন আয়োজন বিরল উদাহরণ। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সচিবালয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় যে বিষয় আমরা দেখছি, এই সমস্যার সমাধান কী? আমরা প্রথম থেকেই ভেবেছি এই সমস্যার সমাধান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করা। এটিই সমাধান।
নিরাপত্তা উপদেষ্টা আরে বলেন, আমাদের ওপর কারও চাপ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যারাই আছেন অংশীজন, আমরা সবার সঙ্গে কথা বলছি। তাড়াহুড়োর কোনও কথা নেই। হিসাব আমাদের সোজা, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে এবং ফেরত গিয়ে আবার যেন ফেরত না চলে আসে। টেকসই প্রত্যাবাসন হতে হবে। আমরা আরাকান আর্মিকে বলে দিয়েছি কোনো এথনিক ক্লিনজিং আমরা মেনে নেব না। আরাকান অস্থিতিশীল থাকলে প্রত্যাবাসনের আলোচনা সম্ভব হবে না।
সমআর্টভাবে কোলণআইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, আরাকান সশস্ত্র বাহিনী যখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সীমান্ত শান্তিপূর্ণ রাখা বাংলাদেশের কর্তব্য।
এদিকে জাতিসংঘ চায় এ নিয়ে দুই সরকারের একটি ঐকমত্য।  জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বরাতে ঢাকা অফিসের ভাষ্য: তারা রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতিতে খুব উদ্বিগ্ন। বিবৃতি দিয়ে এও জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে তারা মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে। জাতিসংঘের এমন বিবৃতিতে একটু দেরিতে হলেও তাদের অভিপ্রায় পরিস্কার। তা’হলে গোলমাল বা সমস্যাটা কোথায়। প্রথমত. কিছুটা গোপনীয়তা। রমজানে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস যখন হাইপ্রোফাইল সফরে এলেন, ঘটা করে কক্সবাজার গেলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইফতার করলেন তখন এ ধরনের টু শব্দও হয়নি। বরং বেশি ফোকাস হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসের খবর। কিন্তু, সামান্য সময়ের ব্যবধানে ফেরতের বদলে আরো বহুসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে। সেইসঙ্গে যোগ হয় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমারকে মানবিক করিডোর দেয়ার বিষয়।
কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মাধ্যমে। তিনি জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর দেওয়ার নীতিগত সম্মতি দেওয়া হয়েছে। তা যতো না মন্তব্য তার চেয়ে বেশি তথ্য। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর তা রাজনৈতিক অঙ্গনকে কাঁপিয়ে দেয়। ভয় জাগায় বিভিন্ন মহলকে। একেক জনের একেক কথনে আলোচনা-সমালোচনার তেজ বেশ তুঙ্গে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা করিডোর শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন, করেই কিন্তু বলেছেন ‘পাথওয়ে’। সেটা স্লিপ অব টাং ছিল। কথাবার্তা অনেক সময় স্লিপ হতে পারে, কিন্তু উনি কারেক্ট করেছিলেন। উনি সেই কথা আর কখনোই বলেননি। আর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস ইউং থেকে বলা হয়েছে, সরকার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু, তারপরও সমালোচনা-ক্ষোভের পারদ নামেনি। যে যা পারছেন বলছেন। বলেই চলছেন।
রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর জন্য মানবিক করিডোর দিতে বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের অনুরোধের তথ্যটি প্রকাশে আসলেই লুকোচুরি না হলেও বিলম্ব হয়েছে, তা এরইমধ্যে পরিস্কার। সংস্থাটির প্রস্তাবে ভাসাভাসা সম্মতিও দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রস্তাবে কয়েকটি শর্তও ছিল। এরমধ্যে রয়েছে- রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি, সবার জন্য সমানভাবে ত্রাণ বিতরণ, শর্তহীন ত্রাণ বিতরণ। এসব শর্ত না মানলে মানবিক করিডোর দিতে নারাজের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনের নাগরিকরা যে খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কটে ভুগছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অজানা নয়। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল। এ কারণে রাখাইনে মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে বাংলাদেশকে বিশ্ব মুরব্বি জাতিসংঘের করিডোরের প্রস্তাব দেয়াই স্বাভাবিক। যা দিয়ে বিপন্ন রাখাইনবাসীর জন্য বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, সার, বীজ, ওষুধসহ ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে চায় জাতিসংঘ।
বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না, বা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডোরের তাগিদ বোধ করে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে মানবিক করিডরের প্রচলন শুরু। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো ১৯৩৮-৩৯ সালে। নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডোর স্থাপিত হলেও সেটি দু’বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দেয় আজারবাইজান সরকার। ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। অনেক জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থও হয়েছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডোরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ।
বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডোর হয়েছে তার কোনো কোনোটি হয় বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়ও হয়েছে  যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন একটি স্বীকৃত পথ বা প্যাসেজের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। তবে করিডোর মানেই যে জলভাগ বা স্থলভাগ হবে এমন নয় বরং এটি সময় নির্ধারণ করেও হতে পারে।
মানবিক করিডোরের অর্থের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ। যা দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে। আরাকানের সাথে  বাংলাদেশের করিডোর এখনো ভবিতব্য। এ ছাড়া, ‘করিডোর-করিডোর’ রব উঠলেও করিডোর আসলে কতো দূর বা তা কোন পথে হবে- তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। স্থল ও নৌ উভয় পথেই করিডোর হতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। এই পথেও করিডোর দিয়ে রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো সম্ভব। করিডোরে মিয়ানমার কি রাজি, বা চেয়েছে?– এ প্রশ্নেরও জবাব নেই। মিয়ানমার সরকার চাইলেও তা সম্ভব? এ প্রশ্নও রয়েছে। করিডোরের জন্য মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন।
এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সংশয়ের কথাও বলা হয়েছে। অন্যান্য প্রায় সকল দলের কথা এ রকমই। সেইসঙ্গে নানা ভয় ও শঙ্কার কথাও বলা হচ্ছে। তাদের সারকথা হচ্ছে, এই করিডোরের মাধ্যমে আরাকান আর্মির মতো একটি রাষ্ট্রবিহীন, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
……….
লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category