• শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩২ অপরাহ্ন

কোটায় ক্ষতির অংক: তদন্তের আগেই ফাইনাল রিপোর্ট?

Reporter Name / ১২৮ Time View
Update : রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক প্রাণহানি, সহিংসতা ও ধ্বংশযজ্ঞের কিছু অংশের তদন্তে নেমেছে বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজ্জামানের বিচার বিভাগীয় কমিশন। কিছু অংশ বলতে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ছয়জন নিহত এবং ৫ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত সংঘটিত সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ২৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে কমিশনের প্রথম বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তথ্যটি জানিয়েছেন স্বয়ং বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজ্জামান। এ সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রমাণসহ ৬ আগস্টের মধ্যে সরাসরি বা ডাকযোগে বা ই-মেইলে কমিশনের কাছে পাঠানো যাবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকার বাইরের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। এর আগে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন নিহত হওয়া এবং সংঘটিত সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজ্জামানকে দিয়ে এক সদস্যের বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।  কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার ইউনিট।
বলার অপেক্ষা রাখছে না পুরো ঘটনা না হলেও অনেক কাজ এই কমিশনের। কিন্তু, নানান কথার মচ্ছব এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মহলকে দোষী সাব্যস্তকরণের মধ্য দিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাজ করে ফেলছে সরকার পক্ষ। সরকার ও সরকারী দলের শীর্ষ পর্যায়, পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর জায়গা থেকেও জোর গলায় বলা হচ্ছে, সহিংসতার যতো কাণ্ড জামায়াত-শিবিরই করেছে। সহায়তা করেছে বিএনপি।  আর যাবতীয় হুকুম বা নেতৃত্ব এসেছে লন্ডন অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের কাছ থেকে। তদন্তের আর বাকি থাকলো কী? প্রশ্ন হলো, তদন্ত কমিটিরই বা এর বাইরে যাওয়া কতোটা সম্ভব হবে?
পথে-ঘাটে উচ্চারিত ও আলোচিত এসব প্রশ্ন। বিএনপি এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। সরকার তা মেনে নিয়েছে। আদালতের নির্দেশনাও আন্দোলনকারীদের পক্ষে। মানে কোটার বিষয়ে সবার মতিগিতি একই। কোনো বিষয়ে আন্দোলনকারী, সরকার, বিরোধীদল এমন কি আদালত একমত হওয়ার এমন ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নতুন। সেখানে সমর্থনকারী একটি দলকে দোষী সাব্যস্ত করাও নজিরবিহীন। দোষী সাব্যস্ত করে এরইমধ্যে বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি নেতাদের সমানে ধরপাকড় করে বিচারের প্রাথমিক কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। জামায়াত নেতাকর্মীদেরও মোটামোটি সাফা করে ফেলা হচ্ছে। আন্দোলনে সমর্থন দেয়া আর নাশকতা যে এক নয়-তা আমল পাচ্ছে না সরকারের কাছে। এসবের মধ্য দিয়ে নতুন করে আরো জটিলতা পাকছে। আসছে পুরনো তিক্ত কথা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল এরইমধ্যে পাল্টা অভিযোগসহ পুরনো কিছু তিতা কথা টেনেও এনেছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারই নাশকতার মদদ দিয়েছে। এই ধরনের নাশকতা হোক, সমস্যা তৈরি হোক—এটা তারাই চেয়েছে। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত চট্টগ্রামের আদালতে এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতার নির্দেশে বাসে আগুন দেওয়ার কথাও টেনে এনেছেন তিনি। সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি বাদ দিয়ে শুধু সরকারি স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা সামনে এনে বিএনপির ওপর দোষ চাপাতে চায় বলেও মূল্যায়ণ তার।
এবারের আন্দোলটি কোটা নিয়ে সূত্রপাত হলেও তা আর কোটাতে ছিল না- তা সামান্য বুঝজ্ঞাসম্পন্ন মানুষও বুঝেছে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনের অ্যাকশন ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এক অর্থে এটি দমন করতে পারা বা থামিয়ে দেয়া। নিয়ন্ত্রণ নয়,  সমাধানও নয়। কোটা আন্দোলন থামাতে গিয়ে সারা দেশে কারফিউ, টানা কয়েকদিন সাধারণ ছুটি, ইন্টারনেট বন্ধ থেকেছে। এর পূর্বাপরে চলেছে প্রানহানিসহ ধ্বংশলীলা।  এসব মিলিয়ে মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে কতো বড় ক্ষত তৈরি হয়েছে, এর জের কতোদিন টানতে হবে- দুয়েক কথায় ধারনা করা অসম্ভব।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সাথে একটা মতবিনিময় সভায় শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সরকার প্রধান জানান, বিটিভি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের শতাধিক গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। সেখানে আগুন দেওয়া হয়েছে। সেতু ভবনে দুবার আগুন দেওয়া হয়। সেখানে ৫০টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কার্যালয়ে হামলা করা হয়েছে। ফার্মগেটে মেট্রোরেল স্টেশন ভাঙচুর; দিয়াবাড়ি মেট্রোরেলের ডিপোতে হামলা; শনির আখড়ায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন ও ভাঙচুর; বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে হামলা ও আগুন; ধানমন্ডির পিটিআইয়ের অফিসে হামলা; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিসে হামলা-ভাঙচুর ও শতাধিক গাড়িতে আগুন দিয়ে পোড়ানো; মহাখালীর ডাটা সেন্টারে হামলা ও অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবমেরিন কেবল নষ্ট করা হয়েছে। মহাখালী করোনা হাসপাতাল, পুষ্টি ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিআরটিএ ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে।
অবস্থা দৃষ্টে এখন হতাহতের বিষয়টি উহ্য রেখে ক্ষয়ক্ষতি জানান দেয়ার এক মৌসুম চলছে। তা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টদের প্রতিটি খাত থেকে আসছে ক্ষতির ভয়ঙ্কর তথ্যচিত্র। শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, বিমান পরিবহন, স্টিল, সিরামিক, সিমেন্ট ও ই-কমার্স খাতেই প্রায় ১৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
১৮ জুলাই থেকে সহিংসতা শুরু হলে সেদিন রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। এতে ইন্টারনেটনির্ভর সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই বন্ধ হয়ে যায়। সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে পরদিন রাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। সেইসঙ্গে টানা ৩ দিন সাধারণ ছুটি। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের কলকারখানা ও যানবাহন চলাচল। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এর মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, তাদের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই খাতের ক্ষতির অঙ্ক প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্টদের এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪২০ কোটি টাকা বলে দাবি । করোনার সময়ও এতো ব্যাপক ক্ষতি হয়নি বলেও দাবি তাদের। স্টিল খাত থেকে দিনে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি করে ছয় দিনে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি করা হয়েছে। ইন্টারনেট-সেবা না থাকায় বিমানে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনসেবাও ব্যাহত হয়। সেখানে দিনে অন্তত ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি ধরে ছয় দিনে অন্তত ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতির অংক ঠিক করা হয়েছে। সিরামিক খাতে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি ধরে মোট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি নির্ধালণ করা হয়েছে। সিমেন্টও অর্থনীতির বড় খাত। এই খাতে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতি দাবি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার একক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং হয়ে থাকে। প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের চার্জ ৪৫ মার্কিন ডলার। এক দিনে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বাবদ বন্দরের আয় কমেছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ও বাল্ক পণ্যেও প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে। ফলে প্রতিদিন বন্দরের আয় কমেছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। গত পাঁচ দিনে এই সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি টাকা হতে পারে। পাঁচ দিনে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। কিছু খাতের ফাইনাল হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সামনে হিসাবের অংক আরো অনেক গড়াবে, তা নমুনাই বলে দিচ্ছে। বিটিভিরই কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
মেট্রোরেল,সেতু ভবন,এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বনভবন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি তো এখন প্রাথমিক বা খসড়া পর্যায়ে। এগুলো মেরামত বা সংস্কারে বাজেট-খরচ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, পিডি মহোদয়দের ক্রিয়াকর্ম শুরু হলে দেখা যাবে বাকিটা। কে কিভাবে কার হিসাব মেলাবেন সেটি পরের বিষয়তো রয়েছেই। টাকার অংকের বাইরে বাংলাদেশের ইমেজের যে সর্বনাশ হয়ে গেল সেটা উদ্ধার কি টাকা দিয়ে হবে? এর দায় কে নেবে? বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না? শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি কেন এই পরিণতির দিকে গেল? কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যখন বারবার আলোচনার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন, সরকারের তরফে ইতিবাচক ঘোষণার আশ্বাসের অপেক্ষায় ছিলেন, তখন আদালতের দোহাই দিয়ে সরকার বিষয়টি এড়িয়ে চলার নীতি নিয়েছিল। ঘটনার পরম্পরা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত’ ঘোষণার পরই মূলত সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়ে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ চড়াও হয়, সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। পরবর্তীতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসছাড়া করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। এরপর সেনা অ্যাকশন। শতাধিক প্রাণহানিকে এড়িয়ে এখন কেবল টাকার ক্ষতিকে সামনে এনে রাজনৈতিক মোড়কে লাভ-ক্ষতি হিসাব সামনে আনার পেছনে আবার কোন রাজনীতি ঘুরছে তা বুঝতে হয় তো বেশি দিন নাও লাগতে পারে। এই নমুনার অংক কষা, ব্যবসায়ীসহ কোনো কোনো মহলকে প্রণোদিত করার নমুনা মানুষ আগেও দেখেছে। প্রাণহানির তথ্য সামনে আনলে গা জ্বলার আর ক্ষেপে ওঠার বাতিকটাও পুরনো। নতুন করে দেখার অপেক্ষা বিচারবিভাগীয় তদন্তের নমুনা। তাদের ফোকাস কোনদিকে যাবে, প্রাণহানিতে না অন্য কোনোদিকে?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category