• শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৪৪ অপরাহ্ন

যুগে যুগে এমনই হয় স্বৈরাচারের পরিণতি। 

Reporter Name / ৮৪ Time View
Update : বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কার্যত তিন দিন দেশ সরকারশূন্য থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১৪ জন এবং পরে ২জন শপথ নিয়েছেন। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যে-ই ছড়াবে, বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে।’
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নতুন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হয়েছেন, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। গণতন্ত্র এগিয়ে নিতে ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। প্রায় একই অবস্থান চীন ও ভারতের। অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও ভারতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
যারা বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারা দেখেছে চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন। যারা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরকে দেখেনি।তারা দেখেছে আবু সাঈদ ও মুগ্ধসহ শতশত শহীদ ভাইদের। যারা একাত্তর সালের আগে পাকিস্তানের জুলুম দেখেনি, দেখেছে স্বৈরাচারী শাসকের একনায়কতন্ত্র, মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচার, গুম ও খুন। অবৈধভাবে নেতা এবং সরকারি আমলাদের টাকার পাহাড়। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার। কানাডায় বেগম পাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি। বেনজিরের দুর্নীতি, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের ছাগলকা-সহ কত কিছু। যারা পাকিস্তানের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা দেখেনি, দেখেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পেছনের দরজা দিয়ে পদত্যাগ করে পালাতে।
শত-শত নাগরিককে হত্যার পর বোন শেখ রেহানাসহ নিজের ও পরিবারের বাকি সদস্য ছাড়া সবার সর্বনাশ করে পালাবেন মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ভেবেছেন কেউই। গোটা দেশ, দল, প্রশাসন ও পরিবারের বাইরে প্রতিটি নেতাকর্মীকেও ফেলে গেছেন অনিরাপদ করে। দাম্ভিকতার ঔদ্ধত্যের অনিবার্য পরিণতিতে দেশ ছেড়ে বেঁচেছেন শেখ হাসিনা। তাদের এ অবস্থায় রেখে জনরোষের মুখে পরিবারের কিছু সদস্যকে আগেভাগে সরিয়ে দিয়ে কেবল ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা মানতে পারছেন না এখন অসহায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা। তাদের প্রশ্ন, তিনি যদি দেশ ছেড়ে পালাবেনই তাহলে কেবল শেখ পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের তোপে ফেলে গেলেন?
পদত্যাগে সই করার আগ পর্যন্ত নানা ছলাকলায় ক্ষমতা না ছাড়ার ব্যাপারে অটল ছিলেন শেখ হাসিনা। সূত্রে প্রকাশ, ঘনিষ্ট ও হিতাকাঙ্খী দু’তিন জন সচিবসহ কয়েকজন তাকে বলেছিলেন, আর আক্রমণাত্মক না হয়ে  নমনীয় হতে। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে দুব্যবহার করেছেন। বলেছেন, তার সঙ্গে না থাকলে তারা নিজেরাও বাঁচবেন না। সেই কনফিডেন্সে শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার কিছু আয়োজন করতে থাকেন তিনি।
পদত্যাগের ঘন্টা দুয়েক আগেও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ধমকিয়েছেন গোটা দেশ রক্তাক্ত করে দিতে। আর দলীয় কয়েক নেতাকে হুকুম দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের যেখানে পাবে সেখানেই যা ইচ্ছা তা করতে।  তাদের মধ্যে চালাকচতুররা এটাসেটা ঘটিয়ে ফেলবেন বলে হম্বিতম্বি করলেও বাস্তবে মাঠে নামেনি তারা।অবশ্য কিছু আবেগি ও দল পাগলরা অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমে জানমালের সর্বনাশ করেছেন, কোথাও কোথাও আবার নিজেরাও মরেছেন। ততক্ষণে আন্দোলনকারীদের সাথে রাজপথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোলাকাত শুরু হয়ে গেছে। তাদের সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং ছিটাতে থাকে। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হয়েও অনিশ্চয়তায় কালক্ষেপণ করতে থাকেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিকট আত্মীয় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানকে তার প্রতি একচ্ছত্র সমর্থন দেয়ার ব্যবস্থা করতে কথা বলেন ওইপক্ষের কয়েকজন আত্মীয়ের সাথে।
এর সমান্তরালে তিনি কথা বলেন, বিদেশে কয়েকটি বন্ধু দেশের প্রভাবশালীদের সঙ্গেও। তারা সায় দেননি। তবে, এক দেশের প্রভাবশালীর বুদ্ধিতে তখন তিনি জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ভাষণ রেকর্ড করার ব্যবস্থা করার নির্দেশও দেন। সেটায়ও কুলাতে পারেননি। ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য আসে দ্যাটস ঠু লেট। পদত্যাগে যত দেরি হবে, তত বিপদ আরো বাড়বে। মার্চ টু গণভবন সফল করতে হাজার হাজার আন্দোলনকারীরা এগাচ্ছে গণভবনের দিকে। আধাঘন্টার মধ্যেই তারা পৌঁছে যেতে পারে গণভবনে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ছুটে যান গণভবনে। তিনি শেখ হাসিনাকে এই বার্তা দেন যে, তিনি যে লকডাউন আহ্বান করেছেন তা বাস্তবায়নে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন তার সেনারা। এতে মেসেজ ক্লিয়ার হয়ে যায়। তা হলো—হাসিনার পক্ষে সেনাবাহিনীর আর কোনো সমর্থন নেই। কাল বিলম্ব না করে কেবল ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে সেনা বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে পৌঁছে দ্রুত একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতের উদ্দেশে চম্পট দেন। খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সাথে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে শাহবাগ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বের হয় বিজয় মিছিল। সব মিছিলের গন্তব্য হয়ে ওঠে শাহবাগ। সারা দেশসহ  ঢাকার অলিগলি ও রাজপথসহ গণভবন থেকে জাতীয় সংসদ—সবই চলে যায় উল্লসিত ছাত্র-জনতার দখলে।তার দেশত্যাগের পর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়।
এর সঙ্গে অবসান ঘটল আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের কাছে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে সব মিলিয়ে পরপর চারবার সরকার গঠন করে দলটি। যদিও ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই ছিল ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ। এর আগে ১৯৯৬ সালের জুনে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনা না পালিয়ে কারাগারে গেলে এমন দুর্গতিতে পড়তেন না বলে নিশ্চিত তার দলের অনেক নেতাদের অভিমত। তাদের যুক্তি হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের পতন হলেও তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি;  জেলে গেছেন। এতে তিনি পরে বার বার সংসদ নির্বাচনে জিতেছেন। তার দলও এখন টিকে আছে। শেখ হাসিনা দলকে এবং দলের নেতাকর্মীদের জন্য সেই অবশিষ্টও রেখে যাননি। টানা ক্ষমতাকালেও তিনি স্বজনদেরই যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ ও যুক্তি তাদের। বিদায়ের সময়ও তাই করলেন। বাদবাকিদের রেখে গেছেন অনিরাপদ করে।  আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে গিয়ে অপব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জাতির প্রতিপক্ষ ও ঘৃণার পাত্র বানিয়ে দিয়ে গেছেন।  ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে ভিন্নমত কেবল দমন নয়, গুম-হত্যা, দেশের সম্পদ হরিলুট-পাচারসহ হেন অপকর্ম নেই যা না করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপব্যবহারের মাধ্যমে। এমন  রেকর্ড বিশ্বে বিরল।
শেষতক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার হুকুমে ছাত্রদের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চালানো হয়েছে তা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার অবিশ্বাস্য নজির তৈরি করেছে। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল  ওয়াকার-উজ জামান অবশ্য হত্যাকাণ্ডের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি পূরণ করা এখনো ভবিষ্যৎ। দেশের অর্থনীতিরও যে সর্বনাশ শেখ হাসিনা করে গেছেন তা আদৌ পূরণ করতে পারা না পারাও  আরেকটি ভবিষ্যৎ।
দেশে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ রেখে পালালেন তিনি। এ হিসাবের অংকটি বাস্তবে আরো বেশি হবে বলে ধারনা অর্থনীতি সম্পর্কে বুঝবানদের কাছে।  দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে এ ঋণ নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেয়ার সময় সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে।  যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গত দেড় দশকে সরকারের অস্বাভাবিক ঋণ বৃদ্ধির এ ক্ষতচিত্র দগদগে হয়ে আছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে বিভিন্ন দেশে। গত দেড় দশকে দেশের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, এর প্রকৃত হিসাব নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ দেশের কোনো পরিসংখ্যানই ঠিক নেই।সবাই জায়গায়ই গোঁজামিল। বহু বছর ধরেই সরকার ক্রমাগতভাবে তথ্য গোপন করেছে। নতুন সরকার অর্থনীতির ক্ষতি নিরূপণের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সেই চেষ্টা করতে পারে।
এদিকে প্রতিবেশি ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সর্বনাশও করে গেছেন শেখ হাসিনা। দেশটির বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ফেলেছেন মহাবিপদে। ভারতের অনেক বিনিয়োগ এখানে। গত আট বছরে ভারত বাংলাদেশকে রেল, সড়ক, বন্দর পরিকাঠামো তৈরির জন্য ৮০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। গত বছরের শেষেই আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ, খুলনা-মঙ্গলা বন্দর রেলপথ চালু হয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত অন্তত এক ডজন ভারতীয় সংস্থার বাংলাদেশে বড় মাপের লগ্নি রয়েছে। জল ও স্থলপথে দু’দেশের মধ্যে একগুচ্ছ সংযোগকারী পরিকাঠামো প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন স্তরে কাজ চলছে। আচমকা শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের ফলে দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোদি সরকার বিব্রত। মোদি সরকারের শীর্ষ কর্তারা বাংলাদেশের নতুন সরকারও প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে অন্তত অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবেন বললেও বাস্তবতাটা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।
ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ১২৯০ কোটি ডলার। ভারত থেকে রপ্তানির পরিমাণে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে। গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১১০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ থেকে মূলত ইস্পাতজাত পণ্য, বস্ত্র ও চামড়ার পণ্য আমদানি করে। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়ানোর জন্য সামগ্রিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের পরেই নরেন্দ্র মোদীর ঘনি‌ষ্ঠ বলে পরিচিত গৌতম আদানির সংস্থার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং প্রতি মাসে ৯ কোটি ডলারের বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে দিল্লিতে নানা গুঞ্জন চলছে। আদানি গোষ্ঠী ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২৫ বছরের জন্য ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে। গত বছরের জুন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। গোড্ডায় উৎপাদিত তাপবিদ্যুতের পুরোটাই আসে বাংলাদেশে। পাশাপাশি ভারতের মতো বাংলাদেশের জন্যও বিপদ আছে। ভারত থেকে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য রপ্তানি ধাক্কা খেলে বাংলাদেশও অসুবিধায় পড়বে।
বাংলাদেশে কখনো এমন পরিস্থিতি হবে তা ছিল ভারতের ধারনার বাইরে। এদিকে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে তাঁদের দেশে থাকার জায়গা দিয়ে নিজেরাও বিব্রতকর অবস্থায় আছে ভারত। দেশটি না পারছে তাকে গিলতে, না পারছে ফেলতে। যা দিন কয়েক আগেও তা ছিল স্বপ্নেরও বাইরে।
দেশে দেশে পতিত শাসকের কার সাথে তুলনা হবেন বাংলাদেশের শেখ হাসিনা? বিচার বা তুলনা হবেন কোন জাতে? বাকি জীবনটা বেঁচেই থাকবেন কার পাতে? দেশে দেশে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদের পরিণতি যুগে যুগে অনকেটা কাছাকাছিই হয়। জনগণের অভিশাপ আর গালি এদের কপালে জোটেই। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তার এ পরিণতিটা ডেকে এনেছেন।  স্বৈরাচাররা সবাই মনে করে তাদের ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী। তাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ঘৃণাকে তারা কিছু মনে করেন না। তাদের কেউ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে, কেউ আবার নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করেন। পৃথিবীর বহু দেশে এ-র নজির বিধ্যমান। ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো বাহামন্ডে একজন স্প্যানিশ সামরিক জেনারেল যিনি ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্পেন একজন স্বৈরশাসক হিসেবে, কৌডিলো উপাধি গ্রহণ করে। স্প্যানিশ ইতিহাসের এই সময়কাল, সাধারণত ফ্রাঙ্কোইস্ট স্পেন বা ফ্রাঙ্কোবাদী একনায়কত্ব হিসাবে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে তার স্বাভাবিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্পেনে একনায়কত্ব গোষ্ঠীর পতন হয়। এ ইতিহাস কারো জানার বাইরে?
তানজানিয়ার সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী বাহিনী ১৯৭৯ সালে সফলভাবে কাম্পালা দখল করে এবং ইদি আমিনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। আমিন নির্বাসনে যান, প্রথমে লিবিয়ায়, তারপর ইরাকে এবং অবশেষে সৌদি আরবে, যেখানে তিনি ২০০৩ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ইরানের পরাক্রমশালী শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলবির দোর্দণ্ড  প্রতাপে দীর্ঘ ৩৮ বছর প্রবল পরাক্রমে ইরানের রাজসিংহাসন দখলে রাখলেও ১৯৭৯ সালে বিদায় নিতে হয় জনবিক্ষোভের মুখে। পতনের পর তার জোটে  মিসরে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তার লাশ দাফনের জন্যও ইরানে আনা সম্ভব হয়েছিল?
আরেক সাড়া জাগানো স্বৈরশাসক ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসও বড় হতভাগা। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারপ্রধান যে কতটা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হতে পারে, মার্কোস তার দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ১৯৭২ সাল থেকে তিনি দেশ শাসন করছিলেন সামরিক আইনের দ্বারা। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে ম্যানিলা এয়ারপোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনোর হত্যাকাণ্ডের পর মার্কোস প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে নিহত অ্যাকুইনোর স্ত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৮৬ সালে গণঅভ্যুত্থানে তার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আশ্রয় জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৮৯ সালে সেখানেই তার করুণ মৃত্যু হয়। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু  একনায়কত্ব কায়েম করে রোমানিয়াকে শাসন করেছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু, ১৯৮৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে তার পতন ঠেকানো যায়নি। যুগে যুগে এমনই হয় স্বৈরাচারের পরিণতি। তবে বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রকে পূঁজি করে বেসামরিক স্বৈরশাসক উপাধি একমাত্র শেখ হাসিনার।
দেশে প্রায় ১৫ বছর ধরে, বিশেষ করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে দেশের মানুষের ওপর অবর্ণনীয় অনাচার, নিষ্পেষণ ও নির্যাতন করেছেন তিনি। সব ধরনের ও সব শ্রেণি ও পেশার মানুষেরা এর শিকার হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্রোধের বিস্ফোরণে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে তার বিরুদ্ধে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এরই মধ্যে নানা ধরনের সুযোগসন্ধানী অপশক্তি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফায়দা নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে এবং নিবে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী-জনতার ‘অভ্যুত্থান’ শেষ হয়েও হলো না শেষ পর্যায় রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পলায়ন করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক নতুন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ তা ঠিক কিন্তু দেশ গড়ার পথে সবচেয়ে বড় যে উপাদানটি বর্তমান বাংলাদেশে অনুপস্থিত, তা হলো গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র অনেক বছর ধরেই অনুপস্থিত, তা ফিরিয়ে আনাই হবে অভ্যুত্থানের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির অন্যতম বড় অর্জন।
বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও শিক্ষিত সমাজকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিপক্ষ হিসেবে নয় আমলাতন্ত্র ও এতে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখতে হবে পরিপূরক সহকর্মী হিসেবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। না হলে বেপোরোয়া, দুর্বল ও অযোগ্য আমলাতন্ত্র কখন কার ওপর চড়াও হয়ে কোনো আচরণ করে বসবে তা অনুমান করাও দুরূহ হয়ে পড়বে। আর এই অভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক অবস্থার মধ্যবর্তী সময়ে যারা দেশকে নেতৃত্ব দেবেন তাদের মানসিকতা কি হবে–এ প্রশ্ন এখন সবার মনে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category