• শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

পেশাক শিল্পে গোলমাল শেষ হবে কবে?

Reporter Name / ৯০ Time View
Update : রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪

– রিন্টু আনোয়ার

নানা গোলমালে তৈরি পোশাক শিল্পে একটি বিপর্যয় যাচ্ছে। কিন্তু, আশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্র্যান্ড নেম কাজে লাগিয়ে এ খাতটিতে একটি জাম্পিং আসবে। তিনি কথাও দিয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টদের। সেই আলোকে  বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে  ইতিবাচক মানসিকতা ও পরিবেশের নমুনাও দেখা যেতে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি বছরের জুন- জুলাইতে তৈরি পোশাক রফতানিতে ভাটার টান পড়লেও আগস্টে সেখানে জোয়ারের রেশ পড়ে। আগস্টে এক মাসেই পোশাক রফতানি হয়েছে অন্তত সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতে সেপ্টেম্বরেই বিপত্তি। শিগগিরই তা উপশমের আলামত দেখা যাচ্ছে না।
আজ এখানে, কাল সেখানে গণ্ডগোল পাকছে। ঢাকা লাগোয়া সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরে যেন এ আগুন খেলার এক খোলা ময়দান। রপ্তানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের সাধারণ কারখানাও হামলা-লুটপাট থেকে বাদ যাচ্ছে না।চারদিকে যখন সংস্কার-সংস্কার আওয়াজ, তখন নানান ছুঁতায় রাস্তায় নেমে শ্রমিক বিক্ষোভ। আর শিল্পধ্বংসের খবর। পরিস্থিতি কারা উত্তপ্ত করছে, তা মালিক-বিনিয়োগকারীরা জানেন-বোঝেন। সরকারেরও না বোঝার মতো নয়। কিন্তু অ্যাকশনটা সেই দৃষ্টে হচ্ছে না। এই ফাঁকে  বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিদেশি অর্ডার প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় চলে যাচ্ছ। এ অবস্থা চলতে থাকলে আসন্ন স্প্রিং মৌসুমের পোশাক উৎপাদন নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা আঁচ করছেন তৈরি পোশাক কারখানা মালিকরা। খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের বড় দিন উপলক্ষে প্রতি বছরই স্প্রিং মৌসুমে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। শার্ট, প্যান্ট, কোট ও জ্যাকেটের মতো সব ফ্যাশনেবল আইটেম তৈরি হয় এ মৌসুমে। আর নভেম্বরের মধ্যে উৎপাদন শেষ করে পৌঁছাতে হয় বিদেশি বায়ারদের কাছে। সেখানে এখন ছেদ পড়ার আশঙ্কা।
এ শঙ্কার পাশাপাশি আশাবাদও আছে। অর্ডারগুলো ফেরত আসা নির্ভর করছে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ও অবস্থানের ওপর। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগানোর ওপর। তার অন্যমানের সুপরিচিত বিশ্বজোড়া।  ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে  বিশ্বের প্রভাবশালী নেতারা তার কাছে বাংলাদেশের জন্য সহায়তার হাতের ওয়াদা দিয়েছেন। সংস্কার, রাষ্ট্র মেরামত, গতিহীন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাসহ সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দেন। এমন একটি সুবাতাসের মধ্যে সভার, আশুলিয়া,  গাজীপুরসহ আশপাশে গার্মেন্টসে বিশৃংখলা ও আগুন পোড়া গন্ধ।
ভালোর মধ্যে এ মন্দের বাতাবরণকে মোটেই যেনতেনভাবে দেখা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে গার্মেন্টস খাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এর যাত্রা শুরু ষাটের দশকে। সত্তরের দশকের শেষের দিকে অন্যতম রপ্তানিমুখী এই শিল্প খাত সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ক্রমাগত বাড়তে থাকে এই শিল্পের যাত্রা।  বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের মধ্যে কেবল ওভেন শার্টের প্রথম অর্ডারটি রপ্তানি হয় ১৯৭৮ সালে। এর পরই বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায় বাংলাদেশের প্রতি এবং এই শিল্পের দ্রুত উন্নতি দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রপ্তানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১ শতাংশ। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাতদ্রব্য মোট রপ্তানিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করে। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাতদ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাকশিল্প রপ্তানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে, যা ছিল তখনকার সময়ের জন্য আমাদের সফল অর্জন, পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে এই শিল্প খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোকের, যার মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ জন মহিলা। তৈরি পোশাকশিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্সসহ অন্যান্য সেবার চাহিদাও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সবটাই অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। বছর কয়েক আগেও কোভিড-১৯ চলাকালেও এই শিল্প খাত বাংলাদেশের সর্বত্র চালু ছিল এবং সেই সময় ভয়াবহ বিপদ মোকাবিলা করে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছিল, যা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সর্বত্র দৃষ্টান্তস্বরূপ।
ম্যাপড ইন বাংলাদেশ-এমআইবির সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ১১৪টি। এর মধ্যে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ২ হাজার ৮৩১। আর এই দুই সংগঠনের সদস্য নয় এমন কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ২৮৩। পোশাক কারখানায় ৪০ লাখ শ্রমিকসহ প্রায় ৬০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামের ৩০ লাখ নারী শ্রমিক স্বাবলম্বী হয়ে আর্থিকভাবে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন পোশাক শিল্পে কাজ করে। গণতন্ত্র হত্যাকারী হাসিনা রেজিমে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পোশাক আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করলেও এখন তা ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপির পাশাপাশি আরো কিছু সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রফতানিমুখি এ শিল্পে কিছু মালিক রয়েছেন যারা হাসিনার তাবেদার হিসেবে চিহ্নিত এবং তারা গার্মেন্টস শিল্প থেকে আয়ের বড় অংশ দিয়ে কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, লন্ডন, দুবাই, সিংগাপুরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তাদের পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এদের কেউ কেউ ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজের কারখানার শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে তাদের রাস্তায় আন্দোলনে নামার কৌশল নিয়েছেন।
বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক সুবিধাজনক স্থানে; যদিও শীর্ষ স্থানে রয়েছে চীন। ডব্লিউটিওর বর্তমান বৈশ্বিক হিসাবে মোট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের দখলে ৬.৪ শতাংশ হিস্যা। ক্রেতারাই চাহিদা অনুযায়ী সব কাপড় এবং সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করে থাকে এবং তাদেরই নির্দেশিত উৎস থেকে বাংলাদেশি উপচুক্তিকারকদের পোশাক তৈরির জন্য কাপড় আমদানি করতে বলে, কাপড় এবং সংশ্লিষ্ট উপকরণ পাওয়ার পর উপচুক্তিকারকরা বিদেশি ক্রেতাদের দেওয়া নকশা অনুযায়ী কাপড় কেটে ও সেলাই করে মোড়কে বেঁধে রপ্তানি করে থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতায় ক্ষতি হয়েছে এই রপ্তানিমুখী খাতটির। ঢাকায় দেশি-বিদেশি বায়িংহাউসগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা সমস্বরে বলেছেন দমবন্ধ করা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
আকস্মিক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো মাঝে মাঝেই মানুষের ফুঁসে ওঠার দেশ, বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের দেশ, গণ-অভ্যুত্থানের দেশ। এই ভূখণ্ডেই ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থান এবং ১৯৯০-এর অভ্যুত্থান। এ ছাড়া ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত এবং ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের মতো বিপুল জনতার অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন হয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।  সমাজ এগিয়ে যায় কিন্তু লাখ-কোটি মানুষের অংশগ্রহণে গড়া আন্দোলনের ফলে সেই প্রভাব সমাজ থেকে হারিয়ে যায় না। বারবার সংকটে পড়লে দেশের মানুষ এসব আন্দোলন থেকে প্রেরণা নেয়, শক্তি পায়। এবারের আন্দোলন এত তীব্র হওয়ার  পেছনে আওয়ামী লীগের অত্যাচার, অহমিকা ও অপমান করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেমন কাজ করেছে, অতীত আন্দোলনের শিক্ষাও তেমনি ভূমিকা পালন করেছে। অতীতের গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, এরশাদ ৯ বছরের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগও ১০ বছরের বেশি থাকতে পারেনি। গণ-আন্দোলনের চাপে তাদের পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে  হয়েছে।
প্রায় এক হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু, চার শতাধিক মানুষের চোখ হারানো, হাজার হাজার আহত হওয়ার ঘটনা স্বাধীনতার আগে ও পরে কোনো আন্দোলনে দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংস কায়দায় দমন করতে গিয়ে এবং আন্দোলনকালীন সহিংসতায় এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। তার অবসান হয়েছে। বিদেশি বায়ারদের এ বিশ্বাসও আছে, বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে জানে ভালোভাবে। ড. ইউনূসকে ঘিরে সেই বিশ্বাস আরো মাত্রা পায়। কিন্তু, রহস্যজনকভাবে সেখানে চলছে একটি আলোআঁধারি খেলা। এর লাগাম টানতেই হবে। এ অরাজক পরিস্থির জন্য প্রতিবেশী দেশের দিকে অভিযোগের তীর। তারা এসব ঘটনাকে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচারের ঝাণ্ডায় বিদেশী ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানসহ সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট জোরদার করতে চায় বলে অভিযোগটি বেশ জোরালো। আলামত বুঝে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করে দেয়া হয়েছে। তারপরও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা ফাঁকফোঁকরে শ্রমিকদের চটাচ্ছে। আফ্রিকায় বর্বর-জংলী-জানোয়ার সিধা করে শান্তি ফেরাতে বিশ্বসুনামের অধিকারী সেনাবাহিনীর মহড়ার মাঝেও চক্রটি তাদের হিম্মত দেখিয়ে দিচ্ছে। এরা নিশ্চয়ই টানা ১৫-১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শৈখ হাসিনা বা তার বাহিনীর চেয়ে দানবীয় শক্তিধর নয়।
পরিশেষে,কারখানাগুলোতে গত দুই দশক ধরেই মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের দূরত্ব ছিল। দাবি দাওয়া উত্থাপনে শ্রমিকদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করতো। এখন সরকার পরিবর্তনের পর শ্রমিকরা কথা বলতে শুরু করেছেন, ফলে
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে সব বকেয়া বেতন ভাতা ঠিক মতো পরিশোধ করতে হবে। যেসব মালিক বা কর্তৃপক্ষ পালিয়ে গেছে তাদের বন্ধ কারখানা সচল করতে হবে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের সম্পর্ক উন্নয়ন করে কারখানার ভেতরের পরিবেশ ভালো করতে হবে যাতে বাইরের সুযোগসন্ধানীরা কোনো সুযোগ নিতে পারবে না। নাহলে,বর্তমান পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস শিল্পে এভাবে অস্থিরতা বিরাজ করলে ব্যবসা যেমন দিন দিন কমবে তেমনি পুরো খাতটাই অস্থির হয়ে উঠবে এবং যে পরিমাণ ইমেজ ক্ষতি হবে সেটা পুনরুদ্ধারে বেগ পেতে হবে সবচেয়ে বেশি।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category