• শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:২৮ অপরাহ্ন

মিয়ানমার প্রশ্নে ভারত-চীন-মার্কিন চক্করে বাংলাদেশ

Reporter Name / ১৫০ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার

বিষফোঁড়া মিয়ানমারের, যন্ত্রণায় কাঁতরাতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও। যুদ্ধ-সংঘাত-বিরোধ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ। নাফ নদী পেরিয়ে সেই গোলা-বোমা এসে পড়ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। লাশ পড়ছে বাংলাদেশিদের।  এর আগে এসেছে রোহিঙ্গার আপদ। এর কোনো ফয়সালা আজতক হয়নি। একজন রোহিঙ্গাকেও এখনতক ফেরত পাঠানো না গেলেও আদরে-সমাদরে ফেরত পাঠানো গেছে মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী-বিজিপি সদস্যসহ ৩৩০ জনকে। প্রায় একই আপদে আক্রান্ত ভারত কিন্তু এত সাদামাটা তা করেনি। ওখানে আশ্রিতদের ফেরত পাঠানোর আগে জবানবন্দিসহ যাবতীয় তথ্যাদি নিয়ে রেখেছে তারা। বাংলাদেশ তা করেনি। রাষ্ট্রের কয়েকটি বাহিনী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের তাগিদ ছিল ফেরত পাঠানোর আগে বিজিপি সদস্যদের কাছ থেকে জান্তাদের তথ্য নিয়ে রাখার। কারণ ঘটনাচক্রে তাদের কাছ থেকে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর নানা অপকর্মের তথ্য তালাশের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
বিশ্বায়ণ ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় এখন মিয়ানমারের সমস্যা আর মিয়ারমার সীমানায় নেই। দেশটির অভ্যন্তরীণ বারুদপোড়া গন্ধ ভারতকেও হজম করতে হচ্ছে। সামনে এর তেজ-ঝাঁঝ আরো বাড়বাড়ন্তের যতো নমুনা। সমস্যাটি এখন আর রাজনৈতিক থাকছে না। উপআঞ্চলিকতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কৌশলগত বড় সার্কেলে। এর ঝাঁঝে চীন চিকন বুদ্ধিতে সাইড লাইন নিয়ে ফেলেছে। তারা মিয়ানমারের জান্তার সাথে আছে। বিদ্রোহীদের সাথেও আছে। অথচ নতুন করে মিয়ানমারের একজনকেও ঢুকতে দেবে না বলে সাফ কথা জানিয়েও কুলাতে পারেনি বাংলাদেশ। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর শরীক সীমান্ত পুলিশ-বিজিপি সদস্যদের আশ্রয় দিতে হয়েছে। সসম্মানে ফেরতও দিতে হয়েছে। সুদূর আটলান্টিকের ওপার থেকে পরিকল্পণা মতো খেলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা সেখানে বার্মা এ্যাক্ট বাস্তবায়ন থেকে এক চুলও সরছে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বার্মা এক্ট ভারতকে এরইমধ্যে বিপদে ফেলেছে। মিয়ানমারের লাখ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই বাস্তুচ্যুত।
কেবল মিয়ানমার বা রোহিঙ্গারা নয়, কম-বেশি প্রায় সব দেশই এ শরনার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশকে পেয়ে বসেছে। আমরা যেখানেই যাই, রোহিঙ্গা বিষয়ে সহযোগিতা চাই। আবার বিদেশি যে বা যারা বাংলাদেশে আসছেন রোহিঙ্গা শরনার্থিদের প্রত্যাবাসনে সহায়তার আশ্বাস দেন। বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা দেন। ছুটে যান কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দেখতে। এ নিয়ে মিডিয়া কাভারেজ হয় ব্যাপক। কিন্তু, বাস্তবটা বড় কঠিন। ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার মুখে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ওই বছরেরই নভেম্বরে তড়িঘড়ি করে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই অসম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পালিয়ে আসা ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে। ‘যাচাই-বাছাই’-এর পর তা থেকে ৬২ হাজার ২৮৫ ব্যক্তিকে ‘ক্লিয়ার’, অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে আগত বলে নিশ্চিত করে মিয়ানমার। এই সংখ্যা মিয়ানমারকে দেওয়া তালিকার ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ মাত্র। এই চুক্তির অধীন গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হয়নি। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও রাখাইনকে ঘিরে পরিস্থিতি সংকটের দিকেই যাচ্ছে। মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ এবং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। রাখাইনে গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দরের বড় প্রকল্প গড়ে তুলছে চীন। নিজের স্বার্থে সেখানে বিনিয়োগ করেছে ভারত। আর বাংলাদেশের ভাগে কেবলই ভোগান্তি।
পরাশক্তিগুলোর স্নায়ুযুদ্ধ ও বিশ্বায়নের গোলমালে আরো জটিল সমীকরণে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতার জেরে বাংলাদেশ-ভারতে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা কথা জানিয়েছেন  দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। এ বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশকে সতর্ক করেছেন তিনি। মিয়ানমার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না-বার্তা দিয়ে লু বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে এই সংকট আরও জটিল হবে। এ-ও বলেছেন, সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে আছে। অস্থিতিশীলতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সমর্থন করবে ওয়াশিংটন। শব্দে-শব্দে, বাক্যে-বাক্যে জটিল কূটনীতি ডোনাল্ড লুর বার্তায়। পারিপার্শ্বিক আলামতেও স্পষ্ট  জান্তার পতন হলেও মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের মধ্যে স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা নেই। বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেক দল-কোন্দল। চীন তাদের নিয়ে খেলছে। সব দলকেই মদদ দিচ্ছে। সুদূর থেকে টোকা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও। প্রকাশ্যে মিয়ানমারের জন্যে বার্মা অ্যাক্ট করেই রেখেছে। বাংলাদেশ নিয়ে এজেন্ডারও শেষ নেই। কাউন্টার অ্যাক্ট করছে বাংলাদেশও।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন-মার্কিন দুই দিকেই মুখ রাখছেন। ভারতের জন্য এটি অস্বস্তির। তাদের সমীকরণে মার্কিনীদের পরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র হবে মিয়ানমার। উদ্দেশ্য চীনকে ভারত ও আরব সাগরে নামতে ঠেকানো।
এবার বাংলাদেশের স্পষ্ট ঘোষণা ছিল—মিয়ানমারের আর একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে বা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু ঘটনার অনিবার্যতায় দিতে হয়েছে। তাও রোহিঙ্গাদের মতো নিরস্ত্র-নিরন্ন গোবেচারা কাউকে নয়। একেবারে অস্ত্রধারীদের। আরাকান আর্মির ধাওয়ায় প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা জান্তা সদস্যদের মধ্যে মূলত বার্মিজ সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপি সদস্যই সর্বাধিক। এই বিজিপিসহ পুরো বাহিনীটাই বার্মিজ সামরিক জান্তার অধীন এবং জান্তা দ্বারা পরিচালিত। এরা সম্মিলিতভাবেই অংশ নিয়েছিল রোহিঙ্গা নিধনে। সেইসঙ্গে চালিয়েছিল গণহত্যা। ২০১৭ সালে তাদের ক্রিয়াকর্মের জেরেই বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে আছে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ফেরত পাঠানো এই বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গা নিধন ও তাড়ানোতে শরিক ছিল। অথবা সবাই ওই কুকর্মে না থাকলেও তারা জানত কারা অংশ নিয়েছিল ওই গণহত্যা ও নিধনে। ঘটনার পরম্পরায় এবার ধেয়ে আসা দেশটির ফৌজি সদস্যরা তখন রোহিঙ্গা হত্যা ও নিধনে কে কতটুকু জড়িত ছিল তা শনাক্তের একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়। তাই তাগিদ ছিল ফেরত পাঠানোর আগে তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য-সাবুদ আদায় করে রাখার; তাদের ২০১৭ সালের ২৪ ও ২৫ আগস্টের ভূমিকা খতিয়ে দেখে নোট রাখা, যা সরকার প্রয়োজনে জাতিসংঘ অথবা আইসিজে বা আইসিসির কাছে হস্তান্তর করতে পারে। ভারত ঠিকই তা করেছে।
এমন এক ঘনঘটার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে ‘ক্রমবর্ধমান’ বিষয়ে সতর্ক করেছে। ডোনাল্ড লু ভারতের মতো অংশীদারের সাথে সহযোগিতায় ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে দিল্লি ও ঢাকা উভয়কেই সতর্ক করেছেন। এর বিপরীতে মিয়ানমারে চীন ক্ষমতাসীন এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে মিয়ানমারে চীনের পক্ষে যা করা সম্ভব তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে করা তত সহজে সম্ভব নয়। এই জটিলতার মাঝেই ছুটে চলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জার্মানিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ রাশিয়া। ঢাকাস্থ রুশ রাষ্ট্রদূতের এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া মারাত্মক ঝাঁঝালো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর টুইট করে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এক্স হ্যান্ডলে এক পোস্টে ভিডিও শেয়ার করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন-‘ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি’। একই দিনে একই সময়ে “অপারেশন ইউক্রেন: আমেরিকার আঙুলের ছাপ। ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদ কে সমর্থন করে?” শিরোনামে রাশিয়ার বাংলাদেশস্থ দূতাবাস ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছে-“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তারপর রাশিয়ার বিরুদ্ধে একসাথে কাজ করার জন্য হিটলারের প্রাক্তন সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।  এর আগের দিন আরেকটি পোস্টে বাংলাদেশকে রাশিয়া মনে করিয়ে দেয় “রূপপুর এনপিপি নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুযোগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তরকে উৎসাহিত করা এবং স্থানীয় শিল্পকে উদ্দীপিত করার কথা। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ফেসবুক পোষ্ট দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিসের বক্তব্য শেয়ার করেছে। সেখানে বলা হয়েছে- “আজ, কিয়েভ স্বাধীন এবং শক্তিশালী। সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার মৌলিক নীতিগুলিকে রক্ষা করতে এবং একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক জনগণকে বশীভূত করা থেকে সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ববাদীকে থামাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সাথে বিশ্ব একত্রিত হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশ কথা বললো। রাশিয়া এই পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা রাখে তা দেখার বিষয় রয়েছে। এর মাত্র ক’দিন আগে, বাংলাদেশ সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রকে চটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।  সব কিছুতে এমন তালগোলের জের কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে- এ নিয়ে একটি আতঙ্কা ঘুরছে দেশের সচেতন সব মহলেই।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category