– রিন্টু আনোয়ার
দেশে না রাজনীতি, না কূটনীতি কোথাও ভালো খবর নেই। অর্থনীতির অবস্থা আরো শোচনীয়। অর্থনীতির টুকটাক ভালো থাকলেও কিছুটা রক্ষা মিলতো। পেটে পড়লে পিঠে সইতো। সেই লক্ষণও নেই। এবার দেবী দূর্গার আগমন ও গমন হবে ‘ঘোটকী’। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবীর এ ধরণের আসা ও যাওয়ার মাঝে চরম অশুভের ইঙ্গিত পান। প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃষ্ট দূর্যোগের আশঙ্কা করেন। তাদের এমন মনে করায় অন্যদের কিছু আসে যায় না। তাদের ধারনা-বিশ্বাসের সঙ্গে অন্যদেরও একমত হতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার আলামত যে শুভ নয়, তাও ঠিক। এর মাঝেই ক্ষমতাসীনদের মারাত্মক অপছন্দের কথা বলে ফেলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান। বাংলাদেশের রিজার্ভ পতনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মিল দেখছেন তিনি।
দেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কা না সিঙ্গাপুর- এনিয়ে বহু কথা আছে। অর্থনীতিকদের কাছে এসবের অনেক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু টানাপোড়েন, অভাব-অনটন বুঝতে পারছেন অর্থনীতি না জানা মানুষও। চারদিকে সংকটের নমুনা তারা দেখছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া এখন আর গোপন তথ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। মূল্যস্ফীতি চরমে। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সও তলানিতে। দেশের প্রধান দুই বাজার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামগ্রিক পোশাক রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
অর্থনীতির এ হাল হলো কেন- সাহস করে কেউ প্রশ্ন তুলছে না। কেন অবিরাম কমছে রেমিট্যান্স? কেউ কি প্রশ্ন করেছে, হুন্ডি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা, হয়ে থাকলে বন্ধ হচ্ছে না কেনো? কার পাপে দেশের পূঁজি বাজার পোড়ে? প্রশ্ন না থাকলে জবাবেরই বা কী দরকার? বরং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, করোনা এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই এখন সময় খারাপ যাচ্ছে, আমাদের অবস্থা বহু দেশের চেয়ে ভালো; যুক্তরাষ্ট্রেও বহু মানুষ না খেয়ে থাকে- ধরনের কথা গেলানোর মিশনটা বেগবান। আর ভেতরে ভেতরে অর্থ ও পূঁজিবাজারের যে চিত্র গণতন্ত্র ও নির্বাচনেরও সেই একই চিত্র! সব কটিই আইসিইউতে। ভেন্টিলেশনে যাওয়া বাকি।
বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় আমদানীর জন্য এলসি করতে ব্যাংকগুলো সঙ্কটে পড়েছে। প্রায় সব পন্যে এলসি খুলতে ব্যাংকগুলো অপারগতা জানাচ্ছে। এরপরে যাও বা খুলছে, তার জন্যে ১০০% মার্জিন চাচ্ছে। এমনিতেই দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে এসে ঠেকেছে। সেই সাথে ব্যাংকের নিজস্ব ফান্ডও প্রায় শুন্যে।
দেশ চালাতে সরকারকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হয়। সরকারের রাজস্ব আদায়ের চাহিদা প্রতিবছরই বাড়ে। রাজস্ব আদায়ের মুল দায়িত্ব মুলত: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। এরা আয়কর,আমদানী শুল্ক আর ভ্যাট আদায় করে। ব্যবসা জনিত মন্দা আর জনমানুষের আয় কমে যাওয়ায় আয়কর আর আমদানী শুল্ক আদায় অনেকখানি কমে গেছে। তাই সব চাপ পড়ছে- ভ্যাট আদায়ের উপর। ভ্যাট পরোক্ষ কর। যা রাস্তার ফকিরকেও দিতে হয়। বলা হয়,আপনারা কর দিন। উন্নয়ন হবে। কর আদায়ের আইনি ব্যবস্থাও দুঃখজনক। যে আইন মানে সে গ্যাড়াকলে পড়ে। যে মানে না বা এড়িয়ে যায় তার সমস্যা হয় না। উপরন্তু, চুরি-পাচারে বীরত্ব পায়। তারওপর গত বছর আর এই বছরে রাজস্ব থেকে- উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে না। হচ্ছে- দেশীবিদেশী ঋণ থেকে। রাখঢাক করে নয়, রীতিমত বাজেটে ঘোষনা দিয়ে। আবার বাস্তবে রাজস্ব আয় কমেছে। তাই কৃচ্ছতা সাধনের কথা বলা হচ্ছে। কৃচ্ছতা সাধনের কাজও হচ্ছে না। বরং ব্যয় আরো বাড়ছে । বাড়তি ওই খরচ মেটাতে সরকারকে উন্নয়ন ব্যয় কাঁটছাট করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত টাকা ছাপিয়ে হলেও ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। এতে মুল্যস্ফীতি বাড়ছে। পরিনামে বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রনের বাইরে ।
পারিবারিক বাজেটের মূলনীতি আয় বুঝে ব্যয়। সরকারি ব্যয়ের ধরন বিপরীত। এখানে আগে ব্যয়ের হিসাব। পরে আয়। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই মন্ত্রনালয় গুলোর কাছ থেকে- এই এস্টিমেট আসতে থাকে। এরপর রাজস্ব আয়ের টার্গেট ধরা হয়। সেই টার্গেট পুরন না হলেও ব্যয়ের সবটাই হয়ে যায়। ডিসি, ইউএনও দের গাড়ী থাকতেও নতুন করে ১ কোটি ৪৫ লাখের নতুন গাড়ী কিনতে হয়। উচ্চ পদস্থদের বিদেশ ভ্রমনে কমতি হলে-তারা গোস্বা করে। এ অবস্থা উতরানোর লক্ষণ নেই।
শ্রীলঙ্কা কিন্তু উৎরানোর দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। তাদের খাদ্য মুল্যস্ফীতি ৯৫% আর গড় মুল্যস্ফীতি ৭০% থেকে কমে এখন ৪% এ এসে দাঁড়িয়েছে। দেশপ্রেম, অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতায় তারা পেরেছে। তাদের এক্সপোর্ট বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, পর্যটন খাতে আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে নেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারের ১৫০ মিলিয়ন শোধ করে দিয়েছে। দেউলিয়া ঘোষিত দেশটি তাদের ঋণদাতাদেরকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেছে। অথচ সেখানে রাজনৈতিক বিরোধ ও হানাহানি ছিল বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। এখন সেখানে ভিন্ন চিত্র। আর এখানে আলুর কেজি ৫০ টাকা মাত্র। কেবল আলু নয়, যখন যেভাবেই পারে পন্যের দাম কৃত্রিমভাবে চড়ানোর নানা ব্যবস্থা আছে এখানে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোজ-মাস্তিসহ দুর্নীতির অপার সুযোগ এখানে। একদিকে কৃচ্ছতা সাধনের কথা বলে হাত তালি আদায় আরেকদিকে সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাস ভ্রমণ বেড়েছে। সরকারি টাকায় ফরেন ট্যুরে মাতোয়ারা কর্মকতারা।
এক্ষেত্রে নিশব্দে টেক্কা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণের শীর্ষ অবস্থানে পুঁজিবাজারের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যন শিবলী রুবাইয়াত উল-ইসলাম। তিনি দেশে থাকার চেয়ে বিদেশ ভ্রমণেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তিনি একা বিদেশ ঘুরার চেয়ে উড়ো জাহাজ ভর্তি লোকজন নিয়ে বিদেশে যেতে বেশী পছন্দ করেন। পুঁজিবাজারের অংশীদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও বাধ্য করা হয় বিদেশ সফর সঙ্গী হতে। একই সাথে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয় বিদেশে অনুষ্ঠিত সেমিনারের খরচ বহন করতে। গোটা দেশে কৃচ্ছতা সাধনের নমুনা কম-বেশি এমনই।
অর্থ খাতে দুর্বৃত্তায়নের আগুনের নেপথ্য শলতেটা রাজনীতির ভেতরে। যাবতীয় মদদ মেলে এখান থেকেই। দেশি এ রোগ সারাতে এখন বিদেশি ডাক্তারদের ধুম যাতায়াত। তাও আবার খাল কেটে ডাক্তার এনে এখন চিকিৎসা নিয়ে টালবাহানা। ওষুধ-পথ্যে গোলমাল। ঝাড়ফুক, মেডিসিন না সার্জিক্যাল? সিদ্ধান্তহীনতায় রোগীর জায়গা এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে। কী রোগে ধরেছে বাংলাদেশকে? রোগীর দশা এতোই চরমে যে, পরম বন্ধু ভারতও বলছে- বাংলাদেশকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে তারা? গভীর পর্যক্ষেণ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ, নজরদারি, কিছিমের কথা মাস কয়েক আগ থেকে বেশি বেশি বলে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দেখাদেখি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও বলা শুরু করে। এক পর্যায়ে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বলতে শুরু করে, নির্বাচন সামরে রেখে বাংলাদেশকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা। এখন বলছে ভারতও।
বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৌড়ঝাপের মাঝে ভারত বেশ চুপই ছিল। তাদের এবারের ভূমিকা কেমন হবে-এ নিয়ে একটি জিজ্ঞাসা চলছিল অনেকের মাঝে। আর সেই নীরবতা ভেঙ্গে ঢাকাকে দিল্লি গভীরভাবে পর্যক্ষেণ করছে বলে জানিয়ে দিলো ভারতও। ভারত প্রকাশ্যে না বলে বরাবরই ভেতরে ভেতরে নিজেদের মতো করে কাজ করে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায়: তলে তলে। ঢাকায় পশ্চিমারা যেভাবে তৎপরতা দেখান সেটি ভারতীয় কূটনীতিকদের কাজের ধরণ নয়, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আবার বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। দেশ দুটিই আবার ভারতের ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে ভারতের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ চীন আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের দিকে সমর্থন প্রকাশ করেছে। এসব কারণেই ভারত প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা না দেখালেও ভেতরে ভেতরে তৎপরতা বন্ধের অবকাশ নেই। তবে, চলমান স্নায়ু-যুদ্ধের সময়, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,ইউরোপ ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ, অবাধ নির্বাচন প্রশ্নে যে অবস্থান নিয়েছে, এর মধ্যে ভারত আগের মতো কোনো বিতর্কিত পদক্ষেপ নেয়ার সক্ষমতা রাখে না বলে বিশ্লেষণ অনেকের। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আবার একদম খোলাসা। বাংলাদেশকে আইসিইউ থেকে বের করতে তাদের চিকিৎসকরা একদম ফ্রন্ট লাইনে। কোনো রাখঢাক নেই।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com