ইউক্রেনে টানা দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আগ্রাসন চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ এই আগ্রাসন মোকাবিলায় এবং একই সঙ্গে মস্কোর সেনাদের বিরুদ্ধে পালটা হামলা চালাতে কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলো। এমনকি প্রতিবেশী পোল্যান্ডও ছিল ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহকারী দেশের তালিকায়।
তবে ইউক্রেনের অন্যতম কট্টর মিত্র বলে পরিচিত এই দেশটি এখন থেকে আর কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ না করার ঘোষণা দিয়েছে।
মূলত ইউক্রেনীয় শস্য আমদানি করা বা না করা নিয়ে বিতর্কের জেরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি।
বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয় শস্য আমদানি ঘিরে কূটনৈতিক বিরোধের কারণে পোল্যান্ড ইউক্রেনকে আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিয়েভকে অস্ত্র দেওয়ার পরিবর্তে আরও আধুনিক অস্ত্র দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করার দিকে মনোনিবেশ করবে তার দেশ।
মূলত শস্য আমদানি ঘিরে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির করা মন্তব্যের জন্য মঙ্গলবার ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল পোল্যান্ড।
এর আগে কিয়েভ থেকে খাদ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রতিবেশী তিনটি দেশের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে মামলা করে ইউক্রেন। ওই তিনটি দেশ হচ্ছে- স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি।
রুশ আগ্রসনের শিকার কিয়েভের অভিযোগ, ইউক্রেনের ইইউ প্রতিবেশীদের এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন।
অন্যদিকে আমদানি বন্ধ রাখা এসব দেশ বলছে, সস্তায় শস্য আমদানির প্রভাব থেকে নিজেদের কৃষকদের রক্ষা করতে এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন ছিল।
বিবিসি বলছে, শস্য আমদানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্রুত উত্তেজনা বৃদ্ধির একদিন পর পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি বুধবার টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে ইউক্রেনকে আর অস্ত্র সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
মূলত গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর থেকে কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচলের প্রধান লেন বন্ধ হয়ে যায় এবং এর জেরে স্থলপথে বিকল্প রুট খুঁজতে বাধ্য হয় ইউক্রেন। এর ফলে মধ্য ইউরোপে প্রচুর পরিমাণে শস্য ঢুকতে থাকে।
আর এর জেরে সেই সব দেশের কৃষকরা তখন থেকেই প্রতিবাদ-সমাবেশ করে আসছেন।
তাদের অভিযোগ, ইউক্রেনীয় শস্যের চালান তাদের ক্ষতি করছে এবং স্থানীয় বাজারকে ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে।
আর সেই চাপের ফলে ২৭ সদস্যের ইইউ ব্লক চলতি বছরের শুরুতে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া এবং সেই সঙ্গে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়াতে ইউক্রেনের শস্য আমদানির ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সম্মত হয়েছিল।
সময়সীমার শেষ হওয়ার দিনে ইইউয়ের নির্বাহী সংস্থা হিসেবে ইউরোপীয় কমিশন এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বুদাপেস্ট, ওয়ারশ ও ব্রাতিস্লাভার সরকার ইউরোপীয় কমিশনের এই পদক্ষেপ মানতে অস্বীকার করে এবং শস্য আমদানির বিষয়ে তাদের নিজস্ব বিধিনিষেধ ঘোষণা করে।
কারণ এসব দেশের আশঙ্কা, ইউক্রেনীয় শস্য তাদের দেশের কৃষকদের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শস্যের দাম কমিয়ে দিচ্ছে।
যদিও ইউরোপীয় কমিশন বারবার বলেছে, ব্লকের মেনে চলা বাণিজ্যনীতির বাইরে ইইউ সদস্যরা পৃথকভাবে কোনো পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া স্ভিরিডেনকো বলেছেন, ‘আমাদের জন্য এটি প্রমাণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, (ইউরোপীয় কমিশনের সিদ্ধান্তের বাইরে) ব্লকের সদস্য রাষ্ট্রগুলো পৃথকভাবে ইউক্রেনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে পারে না। তাই আমরা তাদের (স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি) বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-তে মামলা করছি।’
অবশ্য পোল্যান্ড দিন দুয়েক আগেই বলেছে, তারা সব কিছু অগ্রাহ্য করে শস্য আমদানির বিষয়ে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞা তারা বজায় রাখবে।
পোল্যান্ড সরকারের মুখপাত্র পিওর মুলার বলেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান বজায় রাখছি। আমরা মনে করি এটিই সঠিক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং ইইউ ও আন্তর্জাতিক আইন থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতার ভিত্তিতেই এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলায় ইউক্রেনকে অনেক সহায়তা দিয়েছে পোল্যান্ড। জার্মানির তৈরি শক্তিশালী লিওপার্ড-২ যুদ্ধ ট্যাংক কিয়েভকে সরবরাহে জোর প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশটিকে যুদ্ধবিমান দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে পোল্যান্ড।
এ ছাড়া রুশ আগ্রাসনের জেরে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা ১৫ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে পোল্যান্ড।