আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন। এ জন্য কারিগরিক শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায়ও জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুব কর্মসংস্থানকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষার প্রসারে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাজেটে। এবার শিক্ষায় মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এতে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ। গত অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালে শিক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা।
আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি’-এর জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যে ১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বোনাস বৃদ্ধি এবং গ্রাচ্যুইটি দেওয়াসহ সব স্তরের শিক্ষকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ১৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ২০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জেলা পর্যায়ে পলিটেকনিক এবং উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৯৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ইবতেদায়ি পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাগুলো এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান। প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫ হাজার ৯৪৬টি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ১৭ হাজার ১৬৪টি ওয়াশব্লক নির্মাণ, ৪ হাজার ৪৫০টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৯২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিক্ষার্থীকে ইএফটি’র মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি’-এর জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত অর্থবছর (২০২৪-২৫) এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বরাদ্দ কমেছে ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা
উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিশ্বমানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের ঙঁঃপড়সব ইধংবফ ঊফঁপধঃরড়হ (ঙইঊ) পদ্ধতিতে কারিকুলাম হালনাগাদ করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় ৬২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫১ লাখ, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ৮ লাখ এবং স্নাতক পর্যায়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যে ১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বোনাস বৃদ্ধি এবং গ্রাচ্যুইটি প্রদানসহ সকল স্তরের শিক্ষকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় মোট ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা
বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ১৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ২০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জেলা পর্যায়ে পলিটেকনিক এবং উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৯৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ইবতেদায়ী পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাসমূহ এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাজেট ছিল ৬ লাখ ৩ লাখ ৬৮১ কোটি টাকা। এরমধ্যে শিক্ষায় বাজেট ছিল ১৫.৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এতে শিক্ষার বাজেট ছিল ১৪.৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এতে শিক্ষার বাজেট ছিল ১৩.৭ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এতে শিক্ষার বাজেট ছিল ১৪ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এতে শিক্ষার বাজেট ধরা হয় ১৪ শতাংশ।
শিক্ষায় বরাদ্দ ‘সামান্য’ বাড়ল
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। তবে এটি শিক্ষাখাতে ক্ষত সারাতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এটিকে ‘খুবই সামান্য’ বলছেন শিক্ষাবিদরা। পাশাপাশি শিক্ষার ভিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে, যা নিয়ে হতাশ এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা।
সোমবার বিকাল ৩টায় ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা শুরু করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় বরাদ্দ কমল
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছর (২০২৪-২৫) এ খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বরাদ্দ কমেছে ৩ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ল
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪৭ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা বেশি। যদিও গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ দাঁড়িয়েছিল ৩৯ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা।
কারিগরি-মাদ্রাসায়ও বরাদ্দ বেড়েছে
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ পেয়েছে ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের মূল বাজেটে ছিল ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৮৯৫ কোটি টাকা। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা।
অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ভর্তি বেড়েছে। এ খাত দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল। ফলে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারির সবশেষ ২০২৩ সালের তথ্যমতে, প্রাথমিক স্তরের (প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫ জন। তার আগের বছর ২০২২ সালে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯১ জন।
ব্যানবেইসের ২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী— বর্তমানে দেশে মোট মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার ২৫৬টি। মাদ্রাসায় ভর্তি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১ লাখ ২৬ হাজার ৬২৬ জন, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে এবার বরাদ্দও বাড়ল।