একীভূত হতে চলা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীদের সুরক্ষায় একটি পেমেন্ট স্কিম প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো একীভূত হয়ে একটি বৃহৎ একক সত্ত্বায় রূপ নেবে, যা সম্পদের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত ১.৫২ লাখ কোটি টাকা, যার বিপরীতে তাদের প্রদত্ত ঋণ ছাড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা। আমানতের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ—যা প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা—ব্যক্তি আমানতকারীদের, বাকি অংশ প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর।
আমানতকারীদের অগ্রাধিকার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানিয়েছেন, আমানতের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি আমানতকারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা নগদ অর্থের পরিবর্তে নবগঠিত ব্যাংকের শেয়ার পেতে পারেন।
প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্যক্তি আমানতকারীরা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বীমাকৃত অর্থ পাবেন— যেমনটা আমানত আইনের এর খসড়া সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে এবং বর্তমানে এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর অধীনে ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিলের দুই মাসের মধ্যেই এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
আর ২ লাখ টাকার বেশি আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে, যদিও এ জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা চূড়ান্ত হয়নি। একীভূতকরণের মধ্যবর্তী সময়ে আমানতকারীরা ৪ শতাংশ হারে নির্দিষ্ট রিটার্ন পেতে পারেন, তবে সব বিদ্যমান আমানত স্কিম বাতিল হয়ে যাবে।
কোনো আমানতকারীর যদি পাঁচটি ব্যাংকেই একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে— তাহলে সেগুলো একটি হিসাব হিসেবে গণ্য হবে এবং মোট বীমার সীমা থাকবে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর অতিরিক্ত অর্থ ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
অন্যদিকে, ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হবে না—কিস্তি নিয়মমতো পরিশোধ করতে হবে, আর খেলাপি হলে আগের নিয়মেই শাস্তি কার্যকর হবে।
তবে আমানতকারীদের জন্য পুরো ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা নির্ভর করছে আমানত সুরক্ষা আইনের এর খসড়া সংশোধনী চূড়ান্ত অনুমোদনের ওপর।
নতুন ব্যাংককে মূলধন সহায়তা
পাঁচ ব্যাংক একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের সম্পদ দাঁড়াবে প্রায় ২.২০ লাখ কোটি টাকা। এর পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা—যার মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা আসবে সরকারের কাছ থেকে, ১০ হাজার কোটি টাকা ডিপোজিট ইনসুরেন্স ফান্ড থেকে, আর ৫ হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে পাওয়া যাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত এই বৈদেশিক সহায়তাও পরিশোধ করতে হবে দেশের করদাতাদের অর্থেই।
একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্পগোষ্ঠী নানান পন্থায় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল ঋণের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাপক সমালোচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এর জায়গায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা পুরো একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সময় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন, আর বোর্ড নিষ্ক্রিয় থাকবে।
সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংকই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত, তবে একীভূত হওয়ার পর সেগুলো ডিলিস্ট করা হবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, অবসায়ন বা একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারী নন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী টিবিএসকে জানান।
ডিলিস্টিং প্রক্রিয়া ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈঠক করবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর সঙ্গে। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল হবে, আর একীভূত নবগঠিত ব্যাংকের জন্য নতুন লাইসেন্স দেওয়া হবে।
তবে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ইতোমধ্যেই বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন—পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর বিপরীতে ৫ টাকারও নিচে নেমে গেছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং ছিল ৬৫ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৩১.৪৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংকে ৩৯.২৮ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ৩১ শতাংশ।
এই ব্যাংকগুলোর ক্ষতির প্রভাব গোটা ব্যাংক খাতের বিনিয়োগকারীদের মনোভাবেও পড়েছে। তালিকাভুক্ত ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ডজনখানেক ব্যাংকের শেয়ার এখন তাদের ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর উপরে লেনদেন হচ্ছে।
সবচেয়ে লাভজনক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারের দাম সবচেয়ে বেশি—৭০ টাকার উপরে। তাছাড়া এমনকি শক্তিশালী পারফর্মার সিটি ব্যাংকের শেয়ারও সংগ্রাম করছে।
২০২৪ সালে ১,০০০ কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করলেও – সিটি ব্যাংকের শেয়ারদর ২৫ টাকায় আটকে আছে, যা বর্তমানে ব্যাংকখাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি তুলে ধরছে।
প্রশাসকদের ভূমিকা
ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি কিংবা নিযুক্ত প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে।
প্রশাসকরা ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করবেন, স্থিতিশীলতা রক্ষা করবেন এবং অন্তর্বর্তী সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবেন। প্রয়োজনে তারা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহীদের বদলাতে পারবেন এবং চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
তাদের নিয়োগের ঘোষণা অন্তত দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করতে হবে, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও দিতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রশাসকদের শরীয়াহ-ভিত্তিক ফাইন্যান্সের বিষয়ে দক্ষ হতে হবে, অথবা এধরনের বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োগের অনুমোদন থাকতে হবে, যাতে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হয়।