সরকারবিরোধী আন্দোলন নতুন রূপে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো রাজপথেই আছে। বাকি দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে পৃথকভাবে আন্দোলন শুরু করলেও সবার লক্ষ্য এক। এমনকি কম সময়ের নোটিশে হঠাৎ করে এক মোহনায় মিলিত হতে পারে সব বিরোধী দল। পর্দার আড়ালে এমন রাজনৈতিক ঐক্য প্রস্তুতি বেশ জোরেশোরেই এগোচ্ছে।
প্রথমদিকে কোনো কোনো দল ভিন্ন ইস্যু নিয়ে মাঠে নামলেও একটা পর্যায়ে সবাই একদফা দাবিতে এক কাতারভুক্ত হবে। সরকারবিরোধী এমন বৃহত্তর ঐক্য প্ল্যাটফরমে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির গোপন পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। পুরোনো মিত্র জামায়াত রয়েছে সামনের সারিতে। ইতোমধ্যে মাঠ সরগরম করেছে চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বসে নেই সিপিবি। তারাও আদর্শিকভাবে আন্দোলনের উত্তাপ বাড়াচ্ছে। এছাড়া অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজত ইসলাম সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। মাওলানা মামুনুল হকদের পুনর্বহাল করে পুরোনো নেতৃত্বে হেফাজত শক্তি বৃদ্ধি করছে। রাজনীতির মাঠের এসব সমীকরণ বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, নিকট ভবিষ্যতে মাঠের সব বিরোধী দলকে এক মোহনায় দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এছাড়া বিরোধীদের আন্দোলনের রিমোট কন্ট্রোলের সঙ্গে দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী মহলের যোগসূত্রতার বিষয়টি বেশ জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। এ কারণে রাজনীতি এখন যতটা না প্রকাশ্যে, তার চেয়ে বেশি ঘনীভূত হচ্ছে অন্দরমহলে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী এ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া এ সরকারকে হটানোও যাবে না। তাই যারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তাদের নীতি-আদর্শ যাই থাকুক-সবাইকে একমঞ্চে আসতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারী দলগুলো একমঞ্চে আসতেও পারে। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সরকারের পদত্যাগসহ নানা দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে আন্দোলন করছে। তবে একটা সময় হয়তো সবাই একই মোহনায় আসতে পারে। অতীতে রাজনৈতিক দল কম ছিল। তাদের এক জায়গায় আসা সহজ ছিল। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাই সবাইকে ঐকমত্যে আসাটা কঠিন হবে। তা সত্ত্বেও একমঞ্চে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেরকম হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। সবাই যদি একমঞ্চে আসতে পারে তবে সরকার অনেক বেশি বেকায়দায় পড়বে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আন্দোলনের প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছি। সরকারের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জনগণ আমাদের সঙ্গে রাজপথে নামতে শুরু করেছে। সব দল ও জনগণের সম্মিলিত এ আন্দোলন দ্রুতই একটা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেবে। গণ-আন্দোলনের মুখে কোনো স্বৈরশাসকই টিকে থাকতে পারেনি। এ সরকারও পারবে না।
তিনি বলেন, দুর্নীতি, অপশাসন, দলীয়করণ, দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে এ সরকারের ওপর মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাদের আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। ভয়ভীতি দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখা হচ্ছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আমরা ৩৭ দল যুগপৎ আন্দোলন করছি। বেশির ভাগ দলই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারাও রাজপথে নামছে। যারা এখনো নামেনি, জনগণের চাপে তারাও নামতে বাধ্য হবে।
বিএনপি ও সমমনাদের পাশাপাশি রাজপথে নামছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে। নিত্যপণ্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিসহ জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করবে দলটি। শনিবার এক যৌথ সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আপাতত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিদেশিরা নির্বাচন নিয়ে কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের মানুষ কী বলছে, সেটিই বড় কথা।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যত সোচ্চার হচ্ছে, রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন তত বেগবান হচ্ছে। এছাড়া নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি দেওয়ার পর থেকে আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে।
বিএনপি ও সমমনাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতত্বাধীন বাম ঐক্য। সংসদ ভেঙে দেওয়া, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সিপিবি ইতোমধ্যে সমাবেশ করেছে। শুক্রবার রাজধানীতে এ কর্সসূচি থেকে ১১ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে দলটি। আগস্টজুড়ে বড় বড় জেলায় সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১০ আগস্ট যশোরে রয়েছে তাদের কর্মসূচি। সরকারের পদত্যাগ ছাড়াও তাদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে দুর্নীতি-লুটপাট-অর্থ পাচার-বাজার সিন্ডিকেটের হোতাদের গ্রেফতার ও বিচার এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সেপ্টেম্বর থেকে সিপিবির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামবে। বামপন্থি ছয় দল মিলে এ জোট গঠন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আমরা নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করছি। যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারেন। জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। শুধু একটা নির্বাচন হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি, অপশাসনমুক্ত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক দেশ গঠনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিএনপির কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। রোববার দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনায় পার্থ এমন ঘোষণা দিয়ে বলেন, শিগগিরই দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে নেই জামায়াতে ইসলামী। এক্ষেত্রে অনেকটা কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে দলটি। বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও সরকারের পদত্যাগ ও কেয়ারটেকার সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ কয়েকটি দাবিতে এককভাবে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব দাবিতে সমাবেশ করার অনুমতি চাওয়া হলেও তা দেয়নি সরকার। প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে তারা। শিগগিরই আরও বড় কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দলটির দুজন নেতা যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন।
জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামপন্থি দল হিসাবে চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে বেশ সক্রিয়। সারা দেশে দলটির সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি জনসমর্থনও রয়েছে। সরকারের সঙ্গে দলটির আঁতাতের অভিযোগ ছিল। সে কারণে অন্যান্য দল ভোট বর্জন করলেও সব নির্বাচনেই অংশ নেয় তারা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বরিশাল সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীকে মারধরের কারণে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হন। সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করে দলটি। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার কথা ভাবছে। এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও আপাতত যুগপৎ আন্দোলনে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আলাদাভাবে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সরকারের পদত্যাগসহ নানা দাবিতে সোচ্চার দলটি।
রাজনৈতিক দল ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী ও ইসলামী সংগঠনগুলো নিজ নিজ দাবিতে মাঠে নামতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা মনে করেন, ক্ষমতার শেষ সময়ে সরকার নানা চাপে থাকায় সহজেই দাবি আদায় সম্ভব। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর সম্প্রতি রাজধানীতে এক সম্মেলনে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে অবিলম্বে আলেমদের ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। এ লক্ষ্যে ২০ আগস্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সময় শেষ হয়ে এসেছে। আলেমের মুক্তি আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই সব আলেমকে মুক্তি দিন। না হলে অবস্থা করুণ হবে। গদিসহ সাগরে নিক্ষেপ করা হবে।’
এদিকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ছোট ছোট এমন কিছু দল বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বনিবনা না হলে বিকল্প হিসাবে বিএনপির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার ভাবনা রয়েছে তাদের। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাজীবী ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোও নিজ নিজ দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সময়-সুযোগ বুঝে তারাও নামবে রাজপথে।
আগামী নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা নিয়ে দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই ভোট হবে-এমন অবস্থানে এখনো অনড় আওয়ামী লীগ। সে লক্ষ্যে দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সবশেষ রোববার তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাইকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়নের চিত্র ভোটারদের কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত, তখন সরকারের পদত্যাগে একদফা দাবিতে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি সাজাচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে সমমনাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে দলটি। নতুন কর্মসূচি সম্পর্কে নেওয়া হচ্ছে তাদের মতামত। আগামী দিনের আন্দোলনে সমমনাদের আরও সক্রিয় ও রাজপথে ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
শিগগিরই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের। নতুন কর্মসূচির পাশাপাশি তা সফলভাবে বাস্তবায়নে নেওয়া হবে তাদের পরামর্শ। সমন্বয়হীনতা দূর করে কীভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি সফল করা যায়, এ ব্যাপারে থাকবে বিশেষ নির্দেশনাও।