রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে লুটপাটের কারণে বেড়ে যাওয়া খেলাপি ঋণ এখনো প্রধান সমস্যা। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে ব্যাংকটির নীতিনির্ধারকরা। ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত সংঘটিত অনিয়মের ফলে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৮ শতাংশ।
অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় তিনটি খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। বিশেষ করে ব্যাংকের প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতির অঙ্কও বেড়ে যায়। এর প্রভাবে মুনাফা অর্জনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) এসব সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়, এই ব্যাংককে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে আগের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং আদায়ে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কঠোর অভিযান শুরু করেছে।
বিশেষ করে যারা স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হয়েছে তারা যাতে বিদেশে পালাতে না পারে এজন্য ইমিগ্রেশনে তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য বেসিক ব্যাংক তার শাখাগুলোকে নির্দেশ দেয়।
এরই আলোকে সংশ্লিষ্ট শাখা আদালতের অনুমতি নিয়ে কয়েকজন ঋণখেলাপির পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে জমা দিয়েছে। অন্য খেলাপিদের পাসপোর্টও পর্যায়ক্রমে জমা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও মো. আনিসুর রহমান বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তার আলোকে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং ঋণের হার কমানো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, ঋণ অবলোপন খাত থেকেও অর্থ আদায় করা হবে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি অর্থবছরের কর্মকাণ্ডের একটি পরিকল্পনা বা রূপরেখা নিয়ে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) করে থাকে। সেখানে প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি খেলাপি এবং অবলোপন ঋণ থেকে কত টাকা আদায় করবে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক, লোকসানি শাখা কমিয়ে আনাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিতের চেষ্টা করা হয়। সম্প্রতি চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের এপিএ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বর্তমানে শুধু বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অঙ্ক (মার্চ-২০২৩ পর্যন্ত) ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা।
এপিএ প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে খেলাপিদের কাছ থেকে ১৬০ কোটি টাকা আদায় করা হবে। আগের বছরে আদায় করা হয়েছিল ১৫৪ কোটি টাকা। যে কারণে ২০২২ সালে এই ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৫৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ছিল। তবে ২০২৩ সালে সেখান থেকে কমিয়ে ৪৫ শতাংশে আনা হবে।
বেসিক ব্যাংকের এপিএ প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে বলা হয়, বিদ্যমান ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করে আগামীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা হবে। এছাড়া এই ব্যাংকের অবলোপন ঋণ থেকে চলতি অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের অবলোপন ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।
এপিএ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসএমই, কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্প খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখা হবে। সে লক্ষ্যে শিল্প খাতে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি এ খাত থেকে ৭০০ কোটি টাকা আদায় করা হবে।
এছাড়া প্রভিশন সংরক্ষণ শতভাগ উন্নীত করা হবে। পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি আমানতের পরিমাণ ৩০ শতাংশে আনা, লোকসানি শাখা কমিয়ে ২০টি, এসএমই খাতে ১৫০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ এবং ১৩০০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনার কথা বলা হয়।
অনেক খেলাপি মামলা করে বেসিক ব্যাংকের বড় অঙ্কের টাকা আটকে রেখেছে। সেখানে ৫০টি অর্থঋণ মামলা এবং ১৫টি বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে টাকা আদায় করা হবে। বেসিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের কারণে ২০১৪ সালে খেলাপি ঋণের হার ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল।
২০২২ সালে সেটি নেমে ৫৬ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এখন আমরা চেষ্টা করছি যাতে বিদেশে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা পালিয়ে যেতে না পারে। এজন্য সব শাখায় তালিকা তৈরি করে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপিদের পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে জমা দেওয়া হবে।