দেশের পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরই অংশ হিসাবে শর্ত ছিল ৩ মাস অন্তর জিডিপি (গ্রস ডমেস্টিক প্রডাকশন বা মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির বর্তমান হিসাবে আনতে হবে পরিবর্তন।
এক্ষেত্রে আইএলও’র প্রেসক্রিপশনের পরিবর্তে মানতে হবে আইএমএফ’র গাইডলাইন। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল এ দুটি। ইতোমধ্যেই এসব পূরণে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
তাদের দেওয়া শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে বৈঠক করবে সফররত আইএমএফ’র প্রতিনিধি দল। বৈঠকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে সেসব বিষয়ও জানতে চাওয়া হতে পারে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
রাজধানীর আগারগাঁও পরিসংখ্যান ভবনে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকে বিবিএস’র ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। ইতোমধ্যেই আইএমএফ’র সামনে উপস্থাপনের জন্য একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করেছে বিবিএস। সেখানে উল্লিখিত বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিবিএস’র মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান বলেন, আইএমএফ’র শর্ত এখানে বড় বিষয় নয়। আমাদের পরিসংখ্যানের মান বাড়াতে আমরা নিজ থেকেই নানা উদ্যোগ নিয়েছি। আইএমএফ’র শর্ত দেওয়ার আগে থেকেই ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে (কিউ জিডিপি) জিডিপির হিসাব দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই নির্দেশনা মেনেই কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আইএমএফ বলার পর সেটিতে আরও গতি পেয়েছে। সেইসঙ্গে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয় আইএলও’র প্রেসক্রিপশন মেনে। কিন্তু এখন সেটি পরিবর্তন করে আইএমএফ’র গাইডলাইন মানা হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
তিন মাসে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশ করা হলে কোন ধরনের সুবিধা হবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ৩ মাস পরপর জিডিপির হিসাব প্রকাশ করে। আমরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলাম। এটি করা গেলে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক অবস্থার হালনাগাদ চিত্র পাওয়া যাবে। এতে সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হবে। সরকার প্রয়োজন অনুসারে চলমান নীতি পরিবর্তন কিংবা স্থিতিশীল রাখতে পারবে। এতে তথ্যের ক্ষেত্রে আমাদের আরও একধাপ অগ্রগতি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক দিন আগে থেকেই বছরে চারবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রকাশের বিষয়ে প্রস্তুতি শুরু করে বিবিএস। এখন কার্যক্রম প্রায় শেষের পথে। দেশে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতি ৩ মাস অন্তর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব-নিকাশ প্রকাশ করা হবে। আইএমএফও তাদের ঋণের শর্তে বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
বর্তমানে বছরের শেষ দিকে একবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক হিসাব প্রকাশ করা হয়। এরপর অর্থবছর শেষে আরেকবার চূড়ান্ত হিসাব দেওয়া হয়। যার মধ্যে থাকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের হিসাব। এছাড়া আরও থাকে জিডিপিতে কৃষি, শিল্প ও সেবা-এই তিন খাতের অবদানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
এদিকে বর্তমানে ৮ ক্যাটাগরির অধীনে ৪২০টি আইটেমের বাজার দর নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়। এক্ষেত্রে মানা হয় আইএলও’র প্রেসক্রিসপশন। কিন্তু আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী এখন থেকে আইএমএফ’র গাইডলাইন মেনে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হবে।
এক্ষেত্রে ১২টি ক্যাটাগরির অধীনে ৭২২টি খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত আইটেমের তথ্য নেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই এ প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব প্রকাশ করা হবে সেটি আইএমএফ’র গাইডলাইন মেনেই করা হবে। নতুন পদ্ধতিতে ৭২২ পণ্য ও সেবাকে ১০০ পয়েন্ট ধরে মূল্যস্ফীতিতে এসব পণ্যের অবদান হিসাব করা হবে। এ ক্ষেত্রে চালের অবদান হবে ১৩।
বাকি ৭২১টি পণ্য ও সেবার অবদান ৮৭। প্রথমবারের মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার অবদান ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মানে, মানুষ খাবার কেনার তুলনায় অন্যান্য পণ্য ও সেবা ভোগে খরচ বেশি করছে।
সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি হলো কোনো পণ্য বা সেবার দাম বাড়ার গতির হিসাব, যা করা হয় পণ্য বা সেবার গড় ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এতদিন এই হিসাব করত ২০০৫-০৬ সালকে ভিত্তিবছর ধরে। এখন থেকে ২০২১-২২ সালকে ভিত্তিবছর ধরে এই হিসাব করার কাজ চলছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নীতিমালা (২০১২)। এই পরিবর্তনের বিষয়ে এরই মধ্যে বিবিএস’র একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিবিএস’র পণ্য ও সেবার তালিকায় পরিবর্তন আনা জরুরি ছিল। দেড় যুগ আগে ইন্টারনেট ব্যবহার বাংলাদেশে তেমন একটা ছিল না। স্মার্টফোন ছিল না বললেই চলে। গত ১৬-১৭ বছরের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়েছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এসেছে। প্রবাসে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভিডিও কলের জন্য ইমো, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ যেন অপরিহার্য হয়ে গেছে। যাতায়াতের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। উবার-পাঠাও তো আছেই। গ্রামগঞ্জে মোটরসাইকেল, ইজিবাইকের সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। ফলে যাতায়াতে বৈচিত্র্য যেমন এসেছে, খরচও বেড়েছে। অন্যদিকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। তাই এখন নতুন পণ্য ও সেবার তালিকা করে মূল্যস্ফীতির হিসাব করলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।