কয়েকদিন আগেও যেখানে শুকনো মাঠ খা খা করছিল। আজ সেখানে অথৈ পানি। বর্ষা এলে এভাবেই হাওরের রূপ ফিরে আসে। বিগত এক সপ্তাহের বৃষ্টিতে হাকালুকির রূপ ফিরতে শুরু করে।
এশিয়ার অন্যতম সর্ববৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি হাওর হাকালুকি। বৈরী আবহাওয়ায় চলতি মৌসুমে অনাবৃষ্টিতে হাওরের প্রকৃত চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। অপেক্ষায় ছিলেন হাওর জনপদের বাসিন্দারা।
বর্ষা এলেও হাওরের চিরচেনা রূপ ফিরে আসছে না কেন? তবে গত সপ্তাহের বৃষ্টিপাতে ধীরে ধীরে জলধারে আসছে হাওরের পানি। পানির প্রকৃত রূপ ফিরছে হাওরে। এতে জনপদের বাসিন্দরা পেয়েছেন প্রকৃতির ধরন।
দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাসস্থল হিসেবে এখানে আছে ২৩৮টি বিল। ১৮১১৫ হেক্টর ভূমিতে হাওরের অবস্থান। হাওর পাড়ের মানুষ ও মৎসজীবীদের মতে, এবার দীর্ঘ খরায় হাওরের প্রকৃত চেহারা ফিরে আসতে অনেক দেরি হয়েছে। দেরিতে পানি আসায় হাওরের জলজ উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
হাওরের পানির সঙ্গে আছে আমাদের জীবন সংগ্রামের কত হিসাব-নিকাশ। বর্ষায় মৎসজীবীরা মাছ আহরণ করে সংসার চালান। হাওরের তৃণলতা গুল্ম গোখাদ্য হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। তা দিয়েই চলে গরিবের টানাপোড়নের সংসার। পেশাদার জেলেরা নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপারেও আছে উপার্জনের ব্যবস্থা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ বিলুপ্ত প্রায়। প্রতিবছর এই হাওরে শীতকালে নানান জাতের অতিথি পাখির সমাগম হয়। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইকোট্যুরিজম শিল্প বিকাশের অন্যতম স্থান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
বুধবার (২১ জুন) বিকেলে কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওর পাড়ের গৌড়িকরণ, ভুকশিমইল, মদনগৌড়, মহেশগৌড় ও শাদিপুর গ্রামে দেখা গেছে হাওরের পানি গ্রামের কাছাকাছি চলে আসছে। এ সময় কথা হয় মৎস্যজীবী সজল দাসের সঙ্গে।
তিনি জাগো নিজকে বলেন, ‘এবার ব্লাস্ট রোগে ধানের ফলন কম হয়েছে। অভাব অনটন নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা জেলে সম্প্রদায় হাওরের মাছ ধরে সংসার চালাই। দেরিতে ঢল নামায় এখনো মাছ ধরা শুরু করতে পারিনি। চিরচেনা হাওরের জলের দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় ছিলাম।’
একই গ্রামের মৎস্যজীবী বশির মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘জন্ম থেকেই আমাদের হাওরকেন্দ্রি ক চলাফেরা। দীর্ঘ খরায় হাওর শুকিয়ে যায়। আগের মতো এখন আর দেশি জাতের মাছ পাওয়া যায় না। টেংরা, পুঁটি, চান্দুসহ গুঁড়া মাছ বেশি আছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় মাছ ডিম ছাড়তে পারেনি। এতে বাইম, গোলসা, পাবদা, চাপিলা, শিং, মাগুর, কৈ, এসব প্রজাতির মাছের অভাব দেখা দিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘৪০ বছরেও তিনি এতদিন হাওর শুকনো দেখেননি। দেশি মাছের সঙ্গে হাওরের অনেক জীববৈচিত্র্য জলজ উদ্ভিদও হারিয়ে যেতে পারে। এলাকার মৎস্যজীবী শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আবহমানকালের প্রাকৃতিক নিয়মে বৈশাখে ছোটবড় জাতের মাছ ডিম ছাড়ে। আর আষাঢ়ে মাছগুলো বড় হয়ে ওঠে। এবার হাওরে ভিন্ন চিত্র। বৈরী আবহাওয়ায় এমনটা হয়েছে। পানি হলে হাওরে শাপলা শালুক ভেসে উঠতো । পানি দেরীরিতে আসায় এ সবের দেখা মিলছে না।’
হাকালুকি হাওরের অবস্থান জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। এশিয়ার এই বৃহৎ হাওরে পাহাড়ি ঢলে ১৫-২০ ফুট পানি ওঠে। বৈশাখ মাস থেকে পানি বৃদ্ধি শুরু করলেও এবার আষাঢ়ে দেখা মিললো হাওরের প্রকৃত চেহারা।
হাওর পাড়ের গৌড়িকরণ গ্রামের মোবারক মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্ষার ঢল এলে মনে অন্যরকম অনুভূতি আসে। হাওরের শোভা হচ্ছে পানি। পানির নিচে জমি না ডুবলে উর্বরতা বাড়ে না। অনেক জলজ উদ্ভিদ জন্মায় না। জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। হাওরের চেহারা ফিরে না এলে প্রকৃতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
জুড়ী উপজেলার হাওর পাড়ের জাহাঙ্গীররাই গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মাহী জাগো নিজকে বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে পানিতে হাওর ভরে উঠলে হাওর পাড়ের মানুষের মধ্যে নব উদ্ধিপনা জাগে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেরিতে হাওরে পানি আসায় জলজ উদ্ভিদও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। হাকালুকি হাওর পাড়ের পরিবেশ ও সমাজকর্মী সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবহাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতির তছনছ অবস্থা।’
বিগত বছর এই হাকালুকি হাওর ভয়াবহ বন্যার কবলে ছিল। এবার তীব্র তাপদাহে বিলম্বে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধুলা-মাটি হাহাকার করছিল। ফলে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়বে প্রাণ প্রকৃতি বলে তিনি মনে করেন।