সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরএডিপি) বাদ যাচ্ছে বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। যা এযাবত কালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির সময়ও এত কাটছাঁট হয়নি।
ফলে এ অর্থবছর বৈদেশিক অংশে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে ৭৪ হাজার ২০ কোটি টাকা। এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া আছে ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এই বরাদ্দ কমানোর একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেখানে খাতভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে চলমান সংকট মোকাবিলায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। গত ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এ তাগিদ দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, এর আগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বক্তব্য দেন ইআরডি সচিব শরিফা খান।
এ সময় তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার ৯৩ হাজার (৯২ হাজার ২০ কোটি) কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। মন্ত্রণালয়গুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আরএডিপিতে প্রকল্প সাহায্য বাবদ ৭৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক অর্থ যত বেশি ব্যয় করা যাবে ততই দেশের জন্য ভালো। কোনো কোনো বৈদেশিক উৎসের অব্যয়িত অর্থের কমিটমেন্ট চার্জ দিতে হয়। তাই সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সুযোগ থাকলে প্রকল্প সাহায্যের অর্থ সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশন ও ইআরডি সূত্র জানায়, চলমান সংকট সব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। যেমন অনেক প্রকল্পের বিদেশি ঋণের সঙ্গে ম্যাচিং ফান্ড হিসাবে সরকারি তহবিলের অর্থ রয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উন্নয়নসহযোগীরাও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ ছাড় করতে পারছে না।
ভেতরে ভেতরে সংকটের প্রভাব আছেই, সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। তারা আরও জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ১২ হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা ছিল। পরে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। তবে সংশোধিত এডিপি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আরও কমার আশঙ্কা আছে।
ম্যাচিং ফান্ড নির্ভর করে প্রকল্পের প্রকৃতির ওপর। অর্থাৎ যদি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ বা নির্মাণসংক্রান্ত কার্যক্রম থাকে সেগুলো সাধারণত ম্যাচিং ফান্ড হিসাবে সরকারি তহবিলের অর্থ ধরা হয়। তবে উন্নয়ন সহযোগীভিত্তিক নির্ধারতি কোনো ম্যাচিং ফান্ড থাকে না। এটা নির্ভর করে ইআরডির কর্মকর্তাদের নেগোশিয়েশন (দর কষাকষির) দক্ষতার ওপর।
সূত্র জানায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিপি থেকে বাদ দেওয়া হয় ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাদ দেওয়া হয় ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। সেটি ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমানো হয় ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাটছাঁট হয়েছিল আট হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ।
এদিকে চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে বৈদেশিক সহায়তার ছাড় ও প্রতিশ্রুতি দুটোই কমেছে। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা ৩৭৮ কোটি পাঁচ লাখ ডলার ছাড় করেছে। যা গত অর্থবছর একই সময়ের চেয়ে ৩৯ কোটি ডলার কম। গত অর্থবছরের ওই ছয় মাসে অর্থ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ৪১৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি গত ছয় মাসে মাত্র ১৭৬ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৪০ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি কম এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার। প্রতিশ্রুতি ও অর্থ ছাড় কমলেও বাড়ছে ঋণ পরিশোধ। ছয় মাসে ১০৫ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১০৪ কোটি তিন লাখ ডলার। বৈদেশিক সহায়তা কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে ঋণ ও অনুদান কমেছে। এ ছাড়া কিছু সহায়তা রয়েছে প্রকল্পভিত্তিক। যেসব প্রকল্পের বিপরীতে বৈদেশিক সহায়তা আসার কথা, সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় অর্থ ছাড় কম হচ্ছে। ইআরডির দায়িত্বশীলরা জানান, এ অর্থবছর কোনো প্রকল্পের বিপরীতে বেশি বরাদ্দ নেওয়া হচ্ছে না। কেননা এখন খরচের ওপর পারফরম্যান্স নির্ভর করে। তাই প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা যেটুকু খরচ করতে পারবে বলে মনে করছেন শুধু সেটুকুই নিচ্ছেন।