ডিমকাণ্ড চলতে চলতে আবার পেঁয়াজকাণ্ড। সামনে চিনি নিয়ে আরেক ফসলা ছিনিমিনির আভাস ঘুরছে। মোটকথা দুধ থেকে কচুর লতি কিছুই সিন্ডিকেটের আওতামুক্ত থাকছে না । ক্রেতা সাধারণ এর শিকার। ঘটনাও জানে। সিন্ডিকেট আতঙ্কে ভুগলেও রোখার বা দলবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হওয়ার অবস্থা তাদের নেই। তাই জিনিস এর দাম বাড়ার ভয়ে কষ্ট করে হলেও প্রয়োজনের বাহিরে আরো ২/৫ কেজি বেশী কিনে রাখছেন।
সরকারের অবস্থাও যেন আরো করুণ। অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা। বাণিজ্যমন্ত্রী ঝানু ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসায়ীদের রগে রগে চেনেন। সিন্ডিকেটকেও চেনেন, জানেন। সেই অবিজ্ঞাতর আলোকে সম্প্রতি বুঝেশুনেই তিনি বলেছেন, সিন্ডিকেটে হাত দিলে বিপদ আছে। সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে তারা বাজারে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। তার মানে কি দাড়ালো, সিন্ডিকেট আছে এবং থাকবে। চলছে-চলবেই।
আর সেজন্যই নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট কারসাজি এখন শুধু স্বীকৃত নয়। বৈধও বলা যায়। সব ধরনের পণ্যই তাদের বাণিজ্য কারসাজির আওতাভুক্ত। আজ একটা-কাল আরেকটা বাড়ানো-কমানোর সব ম্যাজিক তাদের হাতে।এখন নতুন করে বাড়িয়েছে ডিম ও পেঁয়াজের দাম। মাছ, মুরগি, ফল ও মসলার দামেও অস্বস্তি। বাজারে সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম জেনেও সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চুপ মেরে থাকার কথা পেটে রাখেননি মন্ত্রী। আগে দায় এড়ানোর চেষ্টা করতেন। এখন আর সেটাও না করে বলে দিয়েছেন এর রহস্য ও সরকারের ভয়ের কথাটা। সিন্ডিকেট না ভাঙার পেছনে তার যুক্তিও প্রকাশ করেছেন একবারে খোলাখুলিভাবে। আর কতো স্বচ্ছ হওয়া সম্ভব একজন মন্ত্রীর পক্ষে!
নিত্যপণ্যের আমদানি এখন প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি মাফিয়া নামধারী শিল্প গোষ্ঠী। বাজারের নিয়ম অনুযায়ী পণ্য আমদানি ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ নেই তদের। প্রতিযোগিতার বদলে তারা একে অন্যের সহযোগী হিসেবে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে সবারই কর্তৃত্ব তৈরি করেছেন। এর ফলে বাজারের ওপর তাদের একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। সরকার সাক্ষী মাত্র। তাদেরকে সেভ করা প্রকারান্তরে সরকারের এখন যেন নৈতিক দায়িত্ব! আর ভোক্তাদের দায়িত্ব এদের শিকার হওয়া।
এদিকে দিন দিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিপদে পড়েছেন ছোট আমদানিকারকদের অনেকে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের এসব আমদানিকারকদের অনেকেই এখন ডলার সংকট আর কথিত সিন্ডিকেট চক্রের সম্মিলিত ‘আগ্রাসনে’ টিকতে না পেরে সরে দাঁড়াচ্ছেন দীর্ঘদিনের আমদানি বাণিজ্য থেকে ।আবার সরে গিয়েও এসব বিষয়ে তারা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, যদি একারণে তাদের অন্য ব্যবসাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এখানে বড়রা সব একজোট। তারাই ঠিক করে দেয় ছোটরা কোন পণ্য কার কাছ থেকে কত দরে কিনবে-বেজবে।
ব্যাংকের এলসি, বন্দরের জাহাজ, বাকিদের মধ্যে বন্টন সবকিছুতেই সিন্ডিকেটের প্রভাব। গত কয়েক বছর ধরেই আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি জরুরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখন কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। আমদানি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করে নিজেদের শর্তে বাজারে পণ্য দিচ্ছে তারা। বাজারে প্রতারণা বা ম্যানিপুলেশন বন্ধ করে ভোক্তাদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য কাজ করা সংস্থাগুলোরও তা জানার বাইরে নয়। বাণিজ্যমন্ত্রী সেই কবে থেকেই বলে আসছেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় ঝুঁকির কথা। এবার একটু খোলাসা করেই করলেন। বাংলাদেশে অনেক সময় কোনো ভোগ্যপণ্যের দাম অতিমাত্রায় বাড়লে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রে বাজারে সেটিও কার্যকর হয় না। বাংলাদেশে চিনি, ডাল, তেলসহ সতেরটি পণ্যকে নিত্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার সবগুলোই সরকারের আশীর্বাদ পুষ্ট বড় কয়েকজন আমদানিকারকদের হাতে। এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যেন অন্যায়।
সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোনো পণ্য অন্য কেউ আনলে সেগুলো বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। শ্রমিকরাও এসব পণ্য খালাসে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে অন্যদের আমদানি করা পণ্য কতদিন সাগরে বা জাহাজে পড়ে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আবার খালাস হলেও কাস্টমস ও কর বিভাগ ছাড়পত্র দেবে কিনা-তা নিয়েও সংশয় থাকে। এভাবে প্রতিটি পদে পদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সিন্ডিকেট। টাকা থাকলেও এদের সাথে কেউ পেরে উঠবে না। এমনকি সরকার একটু দাম নির্ধারণ করে দিলে তারা পণ্য হয়তো জাহাজেই রেখে দেবে কিছুদিন-যাতে সংকটে পড়ে সরকারই চাপ দেয় দাম যাই হোক, পণ্য আনুন। এযেন রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল!
কথিত সিন্ডিকেট বলতে যাদের বোঝানো হয় তারা একদিকে বড় আমদানিকারক, আবার নানা ভাবে ব্যাংকগুলোর মালিকানা এবং ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বও আছে তাদের। আবার সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে খালাসের জন্য ব্যবহৃত লাইটার জাহাজগুলোও তাদের কিংবা তাদের সহযোগীদের। ফলে শ্রমিকরাও মালিকদের বাইরে গিয়ে অন্য কারও জন্য কাজ করতে পারেন না বিপদে পড়ার ভয়ে। সব কিছুই এই সিন্ডিকেটের হওয়ায় সরকারের রাজস্ব বিভাগের লোকজনও থাকেন চাপের মুখে।
মোটকথা মুক্তবাজারে সরকার হস্তক্ষেপ করে না, করবে না বা করতে পারে না- ধরনের কিছু কথামালা প্রচলিত আছে। কার্যত এগুলো একদম বাজারি কথা। তাওপর এসব কথার মধ্যে রয়েছে এন্তার ফাঁকফোকর। কথার নামে কুকথা। কারণ,প্রশ্ন তো বাজারে হস্তক্ষেপের নয়, বাজার নষ্টের হোতাদের শায়েস্তা করার। এটি সরকারের দায়িত্বও। কিন্তু, বাস্তব বড় কঠিন। চিনি-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে নুন-মরিচ, কচুর লতি-শুটকি পর্যন্ত যাবতীয় নিত্যপণ্য এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম, মজুত, সরবরাহসহ কোন কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ক্ষেত্রবিশেষে মনিটরিংও নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে এতটা নতজানু? দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের টাকা কিংবা পৃষ্ঠপোষকতায় চলে,সেটি নতুন খবর নয়৷ রাজনৈতিক মহলের অনৈতিকতার কারণে এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর নেতারা এখন শুধু আড়ালে থাকছেন না, সরাসরি রাজনীতির মাঠেই নেমে পড়েছেন৷ তারাই আইন প্রণয়ন করছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক করছেন, নিত্যপণ্যসহ সব জিনিসপত্রের বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সাড়ে ১৭ ভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী৷ ১৯৯১ সালে যা বেড়ে ৩৮ ভাগে দাড়ায়৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই পেশায় ব্যবসায়ী ৷ মোট সংসদ সদস্যের যা ৬২ ভাগ৷ বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধাণ্য পাবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু, সত্যটা লুকানোর যতো চেষ্টা আছে, তার সবই করা হয় সিন্ডিকেটের অনুকুলে। দেয়া হয় নানা অজুহাত। শীত-গরম-বৃষ্টি-খরাসহ অজুহাতের শেষ নেই এখানে। দ্রব্যমূল্যের উচ্চহারে নিম্ন আয়ের মানুষের নাকানিচুবানিকে ঢাকতে দেখিয়ে দেয়া হয় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির অংক দেখানোর পাশাপাশি বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে স্থানীয় পণ্যের দাম বাড়ানোরও মহাওস্তাদ তারা। বিশ্ববাজারে দাম কমলে স্থানীয় বাজারে কমায় না। বিশ্ববাজারে যে চালের দাম কমতির দিকে, তখনও কেন বাংলাদেশে বাড়তি?- এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আশপাশের অন্য কথা বলে। গমের দামেও একই অবস্থা। সরকারের হিসাবে দেশে চালের উৎপাদন ও মজুত দুটিই সন্তোষজনক। বিশ্ববাজারে গমের দাম টনপ্রতি ২০-২৫ ডলার কমলেও বাংলাদেশে বাড়ার কারণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে ডলার সংকটের অজুহাত। ডলার-সংকটের আগে তাহলে চালসহ খাদ্যপণ্যের দাম কেন বেড়েছিল, সেই প্রশ্ন করলে চটে যায়। নগদে কিছু অজুহাত সামনে নিয়ে আসে। তাদের চালবাজি-কারসাজির কথা এড়িয়ে যায়। রমজান শুরুর ঢের আগেই তারা বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে যে জায়গায় নিয়ে যায় তাতে রমজানে আর না বাড়ালেও চলে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামও কমেছে। দেশে এর ছোঁয়া তেমন লাগেনি।
আদতে যাপিত জীবনে মানবীয়-দানবীয় উভয় তৎপরতার সঙ্গে আমরা কবে থেকে পরিচিত?-সন-তারিখ দিয়ে বলা মুশকিল। এটি ভাবনারও অবান্তর। সবখানে দানবীয় দাপট নিরঙ্কুশ হয়ে পড়ার ছাপ সবখানে। নির্বিচারে পকেট কাটার শিকার হতে মানুষও যেন প্রস্তুত হয়েই থাকে। বঙ্গবাজার-পুঁজিবাজার, দেবালয়-লোকালয় মোটেই লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। যার যেখানে সুবিধা হয় মওকা হাছিলই লক্ষ্য। ফুটপাতের ভাসমান দোকান থেকে শুরু করে যুগ-যুগের প্রচলিত হাট-বাজার, রেস্তোরাঁ কিংবা হালের আধুনিক চেইনশপ সবখানেই মওকা। পাল্লা দিয়ে প্রায় সব সেক্টরে অসংযত ও লুটোপুটির মহৌৎসব।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
– রিন্টু আনোয়ার