গাজায় ইসরাইলি আক্রমণের মূল টার্গেট এখন হাসপাতালগুলো। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে হামলা চালাচ্ছে প্রতিদিন। বন্ধ করে দিয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। হাসপাতালগুলো টার্গেট করে যখন তখন বোমা হামলা চালাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সগুলোতেও। পরিস্থিতি এতটাই অস্বাভাবিক যে হাসপাতাল থেকে বাইরেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বন্দুকধারীদের সাহায্যে হাসপাতালের ভেতরেও চালানো হচ্ছে গুলি।
গাজার সর্ববৃহৎ হাসপাতাল আল-শিফার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ৯ নভেম্বর থেকেই ইসরাইলিদের দখলে রয়েছে হাসপাতালটি। কোনো রোগীকেই সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যেই ডাক্তার এবং বেসামরিকদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করছে ইসরাইল। আল-রিমাল জেলায় অবস্থিত শিফা হাসপাতাল থেকে দক্ষিণে পালাচ্ছেন অসংখ্য চিকিৎসক।
সোমবার শিফাসহ গাজার সর্ববৃহৎ আরও একটি হাসপাতাল আল-কুদসকে ‘পরিষেবার বাইরে’ ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও ডাক্তাররা রোগীদের ছেড়ে যেতে চাননি। পরবর্তী সময়ে ইসরাইলি আলটিমেটাম, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাংক শেলের আক্রমণে তারা হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনি সার্জন হায়া আল-শেখ খলিল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) রাতে ইসরাইলি বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র ও ট্যাংকের শেল দিয়ে বহির্বিভাগের রোগীদের ক্লিনিক ভবন এবং প্রসূতি ও স্ত্রী রোগবিদ্যা ভবনকে আক্রমণ করছে।’ ডাক্তার খলিল আরও বলেন, ‘আল-শিফা হাসপাতালে ইসরাইলি দখলদারত্বের নৃশংসতা আমি বুঝতে পারছি না।
হাসপাতালটিতে অসংখ্য রোগী তাদের পুরো পরিবারকে হারিয়েছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যদের রেখে গেছেন। আমার অপারেশন করা বেশিরভাগ শিশু, পর্যাপ্ত চিকিৎসাকর্মী, চিকিৎসাসামগ্রী, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির অভাবে মারা যাচ্ছে।’ এমনকি উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার সময়ও কঠিন অভিজ্ঞতার শিকার হন ডা. খলিল।
রাস্তায় ইসরাইলি বাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ, মারধর ও সহিংসতার জন্য অনেক যুবককে গ্রেফতার করে। তিনি বলেন, ‘রাস্তাটা ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো। সৈন্যরা আমাদের দিকে তাদের রাইফেল তাক করে ছিল। আমরা প্রচণ্ড তাপে অনেক দূর হেঁটেছিলাম। এটি ক্লান্তিকর এবং ভয়ংকর ছিল। আমরা দেখেছি দখলদার সৈন্যরা একজন ফিলিস্তিনি যুবককে লাঞ্ছিত করছে এবং তাকে তার পোশাক খুলে ফেলতে বাধ্য করছে। তারা আরেক যুবক ও তার শিশুকে মারধর ও অপমান করেছে।’
সোমবার যুগান্তরকে পাঠানো বিবৃতিতে হামাস সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হাসপাতালের ভেতরে এখনো ৮০০০ মানুষ রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০০-৬৫০ জন রোগী, ২০০-৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী, বাকিরা শরণার্থী। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, শুক্রবার আল-শিফায় অবরোধের পর লাইফ সাপোর্টে থাকা কমপক্ষে সাতজন রোগী মারা গেছেন, যার মধ্যে দুজন শিশুও রয়েছে। বিদ্যুতের অভাবে ভেনটিলেটর এবং ইনকিউবেটর কাজ না করায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।
রোববার (১২ নভেম্বর) সকালে, গাজায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ডা. মুনির আল-বর্শ বলেন, হাসপাতালের প্রায় ৪০ জন বাস্তুচ্যুত লোক মূল ফটক দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী রাস্তায় অবস্থানরত একটি ইসরাইলি ট্যাংকের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুহূর্তেই তাদের লাশ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স এবং কর্মীরা তাদের ১০০ মিটারেরও কম দূরত্বে ছিল। তবে তারা সাহায্যের জন্য যেতে পারেননি। কারণ, যারাই তাদের অবস্থান থেকে সরছিল তাদের ওপরই গুলি চালাচ্ছিল ইসরাইলি বাহিনী। এমনকি ইসরাইলি বাহিনী রাতভর মেডিকেল কমপ্লেক্সের পানির কূপে বোমাবর্ষণ করেছে। এমনকি আল-শিফার হাসপাতাল কর্মীরা ১০০টি পচনশীল লাশ দাফন করতে পারেননি। গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা ওয়াফা বলেন, ‘এর মধ্যে পরিস্থিতির জন্য শিফা হাসপাতালের অভ্যন্তরেই লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে ইসরাইলি অবিরত বোমাবর্ষণে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কমপক্ষে ১০০ জনের লাশ দাফন সম্ভব হয়নি। এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন ফিলিস্তিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা।