রাজধানীর রমনায় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তখন গরম অনুভূত হয়েছে ৪৩ ডিগ্রির মতো। একই সময়ে গুলশানে ব্যারোমিটারের পারদ ৩৬ ডিগ্রিতে উঠলেও এর অনুভব মাত্রা ছিল ৪৩। অর্থাৎ বাস্তবের তাপমাত্রার চেয়ে ৭ ডিগ্রি বেশি অনুভব করছে মানুষ।
একপর্যায়ে ঢাকায় দিনের তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে সূর্য যখন গোধূলির দিকে যাওয়ার পথে, তখনো বাড্ডার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি, আর তখন মানুষের শরীরে এর অনুভূতি ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এর আগে ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। সেই হিসাবে ৯ বছরের মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলো।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকা গত কয়েকদিন ধরে গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে তাপমাত্রা থাকে এক আর তার অনুভব মাত্রা থাকে আরেক। স্থানভেদে এটা ২ থেকে ৭ ডিগ্রি বেশি থাকে। মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে পড়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গোটা এলাকায় দীর্ঘদিনের বৃষ্টিশূন্যতা। মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য সরাসরি কিরণ দিচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে ধেয়ে আসছে লু হাওয়া। এসব কারণে এমন দাবদাহ পরিস্থিতি চলছে। ফলে গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে জনজীবনে। মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড দারুণভাবে বিঘ্নিত।
বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুর্ভোগে আছে খেটে খাওয়া ও নিম্নআয়ের মানুষ। আবহাওয়ার দেশি-বিদেশি কোনো পূর্বাভাসই আগামী এক সপ্তাহে পরিস্থিতি উত্তরণের সুখবর দিচ্ছে না। বরং আগামী কয়েকদিন ঢাকাসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় তাপমাত্রা আরও কিছুটা বাড়তে পারে। আর বৃষ্টি হলে বাতাসে আর্দ্রতা বাড়বে। এতে স্বস্তি নয়, বরং গরমের কষ্ট বাড়ার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান বলেন, এপ্রিলে বাংলাদেশ এবং ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এমন গরম থাকে। এই সময়ে সূর্যের অবস্থান কিছুটা কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু অন্যান্য বছর মাঝে মধ্যে কালবৈশাখিসহ বৃষ্টি হয়। এছাড়া স্থানীয় বায়ুমণ্ডলে থাকে বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে আসা জলীয়বাষ্পসমৃদ্ধ দক্ষিণা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু। কিন্তু এ বছর দক্ষিণা বায়ু খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে। বিপরীত দিকে পশ্চিমা লঘুচাপ ব্যাপক শক্তিশালী। যে কারণে গরমের প্রভাব দিন দিন বাড়ছেই।
সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শনিবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
একই সংস্থার আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ভারতের রাজস্থানের মরুভূমির দিক থেকে যে তপ্ত বায়ুপ্রবাহ তৈরি হয়, তা বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। বিহারের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলও উষ্ণ হয়ে ওঠে। সেটিই পরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
উভয় আবহাওয়াবিদ মনে করেন, আগামীকাল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের দিকে সামান্য বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু তা সংশ্লিষ্ট এলাকা শীতল করার মতো নয়। তবে আগামী ২২ এপ্রিলের দিকে দেশে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। ২৪ এপ্রিলের পর বৃষ্টিসহ কালবৈশাখি বয়ে যেতে পারে। তখন তাপমাত্রা নিম্নমুখী থাকবে।
মার্কিন আবহাওয়া চ্যানেল এসিসিইউ ওয়েদার জানায়, ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন গরমের অনুভূতি ছিল ৪৩ ডিগ্রি।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান দ্য ওয়েদার চ্যানেলের আগামী ৯ দিনের পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, ২০ এপ্রিল বা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দৈনিক তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি করেই থাকতে পারে। ২১ এপ্রিল তা ৩৯ ডিগ্রিতে নামতে পারে। সেদিন দেশের কিছু এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে। ২২ এপ্রিল দেশে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে পারে। সেদিন তাপমাত্রা আরেক ডিগ্রি কমতে পারে। এভাবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে ৩৬ ডিগ্রিতে দাঁড়াতে পারে।
তবে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তাপমাত্রা তাপপ্রবাহের পর্যায়ে থেকে বৃষ্টিপাত হলে আরেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাপপ্রবাহের সঙ্গে বাতাসে জলীয়বাষ্প বা আর্দ্রতা বেশি থাকলে সাধারণত মানুষের শরীরে ঘাম বেশি হয়। স্যাঁতসেঁতে শরীরে তখন অস্বস্তিকর গরমের অনুভূতি তৈরি করে। এর সঙ্গে আকাশে মেঘ থাকলে ভ্যাপসা গরম লাগে। সেটা আরও খারাপ। তিনি বলেন, তাপপ্রবাহের দুটি রূপ আছে। একটি হচ্ছে-শুষ্ক অবস্থা, আরেকটা আর্দ্র পরিস্থিতি। বর্তমানে আর্দ্রতা কম আছে। এ কারণে ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়াসহ শরীরের চামড়া পুড়ছে মনে হচ্ছে।
বিএমডি বলছে, বর্তমানে দেশে উল্লিখিত তিন ক্যাটাগরির তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছ। এর মধ্যে গোটা খুলনা বিভাগ এবং ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে শুক্রবার তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। শনিবার অবশ্য তা ৮ জেলায় নেমে আসে। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া। এছাড়া দেশের বাকি অংশের কোথাও মৃদ্যু আবার কোথাও মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
শনিবার ১৪তম দিনের মতো দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়। ব্যারোমিটারে এদিন সেখানকার তাপমাত্রা চিহ্নিত হয় ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার বাংলা নববর্ষের দিনও ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, যা ওই জেলায় গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তাপপ্রবাহ শুরুর পর গত ২ এপ্রিল ওই জেলায় সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। সেই থেকে রেকর্ড ধরে রেখেছে এ জেলা।
এর আগে ১৯৬৫ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল ঢাকার তাপমাত্রা। গত কয়েকদিনের রেকর্ডে দেখা গেছে, ঢাকায় তাপমাত্রা কেবলই ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ছিল ৩৯ দমশিক ৫ ডিগ্রি, ১২ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি, ১১ এপ্রিল ৩৮ দশমিক ৫ এবং ১০ এপ্রিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি।