জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষ্যে নানা আয়োজনে নয়াদিল্লিকে সাজিয়েছে ভারত। ঝাড়বাতি আর রঙ বেরঙের আলোয় ছেয়ে গেছে গোটা রাজধানী। সেইসঙ্গে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে কঠোরভাবে।
দেয়ালে দেয়ালে ইতিহাস তুলে ধরছে ভারত
দিল্লির দেয়ালে দেয়ালে নিজেদের ইতিহাস তুলে ধরছে পথশিল্পীরা। পৌরাণিক কাহিনি ও নৃত্যের ধরনগুলো জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠছে রং তুলিতে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য দেশটির শহরের দেয়ালগুলোকে আরও সৃজনশীল ও প্রাণবন্ত করে তুলতে দিল্লির নাগরিক সংস্থাগুলো স্থানীয় শিল্পীদের নিয়োগ করেছে। মাসদুয়েক আগে থেকেই কাজ শুরু করেছেন পথশিল্পীরা। জনপ্রিয় ভারতীয় স্মৃতিস্তম্ভ থেকে শুরু করে ময়ুর, গাছ, পদ্ম, গরু, মাছ, হরিণের চিত্র আঁকা হয়েছে। কীর্তিমান ব্যক্তিত্বসহ তুলে ধরা হয়েছে রেলগাড়ির ছবি। ঐতিহ্যবাহী শিল্পশৈলীতে উঠে আসে দেবতাদেরও ছবি। শুধু পৌরাণিকই নয়, আধুনিক ভারতের সৌন্দর্যও তুলে ধরা হয় চমৎকারভাবে। পিটিআই।
প্রগতি ময়দানের আশপাশে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের মতে, সম্মেলনকেন্দ্র ভারত মন্ডপম কনভেনশন সেন্টারের আশপাশের এলাকায় ২০ থেকে ৩০ জন পথশিল্পীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দিল্লি রেলওয়ের ১৩ নম্বর সেতুর নিচে যেখানে রাস্তাটি ৩ ভাগে বিভক্ত হয়েছে, সেই দেওয়ালের প্রতিটি পাশে নজরকাড়া রঙে সজ্জিত করা হয়েছে। কারণ এ পথ ধরেই বিশ্বনেতারা পৌঁছাবেন দুদিনের শীর্ষ সম্মেলনে। একটি দেওয়ালে স্টিম ইঞ্জিনের রেলগাড়িকে সেতু অতিক্রম করার চিত্র দেখানো হয়েছে। অপর দেয়ালে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসকে ছুটে চলার দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। এর মাধ্যমে আধুনিক ভারতের চিত্র তুলে ধরা হয়।
আরেকটি দেয়ালে কথক, কথাকলি, ভারতনাট্যম, ঘুমর, মণিপুরি ও মহিনিত্তম নৃত্যের মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন ভঙ্গি চিত্রায়িত হয়েছে। অন্যান্য দেয়ালচিত্রের মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যেমন আহিল্যাবাই, মহারানা প্রতাপ, পৃথ্বীরাজ চৌহানের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছ। স্যাঁতসেঁতে দেয়ালগুলোও শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো হয় নিখুঁতভাতবে।
শিল্পী ইরফান খান (২৬) রেলওয়ের রাস্তার দেয়াল চমৎকারভাবে সাজিয়ে তুলেছেন। যত্ন সহকারে সূক্ষ্মতার সঙ্গে বিমূর্ত তরঙ্গ এঁকেছেন। খান একজন স্বশিক্ষিত পথশিল্পী। ভারতের উত্তর প্রদেশের ছোট একটি গ্রামের বাসিন্দা। মেগা ইভেন্টের জন্য ভারতের রাজধানীকে একটি শৈল্পিক রূপ দেওয়ার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। দেবতাদের বিশাল বিশাল ছবি আঁকতে অবদান রেখেছেন। এঁকেছেন নৌকায় বসে থাকা দেবতাদের ছবি। খান বলেন, ‘আমি কৃষ্ণ, বজরংবলী, শ্রীরাম ও অন্যান্য দেবতাদের ছবি তৈরি করেছি।’ এজন্য অনেক গর্ববোধও করেন।
আরও বলেন, আমি ভারতের শহরের অনেক রাস্তায় শিল্পী হিসাবে কাজ করেছি। এখন প্রগতি ময়দান এলাকায় দৈনিক মজুরি শিল্পী হিসাবে কাজ করছেন। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার জন্য ৭০০ রূপ পান। গত দেড় মাস ধরে এ কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
কেন পদ্ম হলো লোগো
আর মাত্র দুই দিন পর ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গ্রুপ অব-২০ (জি-২০) শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনের লোগো হিসেবে পদ্ম ফুলের প্রতীককে বেছে নিয়েছে ভারত। নিছক কোনো উদ্দেশ্যে পদ্মকে বেছে নেওয়া হয়নি। ভারতের জাতীয় পতাকার প্রাণবন্ত রং জাফরান, সাদা, সবুজ ও নীলের সঙ্গে পদ্ম ফুলের আছে দারুণ মিল। গত বছরের ৮ নভেম্বর পদ্মকে সম্মেলনের লোগো হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
একটি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লোগোটি উন্মোচন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বলেছিলেন, ‘ভারত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সভাপতিত্ব এমন একটি সময়ে পেয়েছে যখন বিশ্বে চলছে বিভিন্ন সংকট, বিশৃঙ্খলা আর তার বিপর্যয়কর প্রভাব। মহামারি, দ্বন্দ্ব আর প্রচুর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকালীন জি-২০ লোগোতে পদ্ম একটি আশার প্রতীক।’ আরও বলেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, পদ্ম ফোটে। একইভাবে বিশ্বের গভীর সংকটের মধ্যেও উন্নতির পথ চলমান থাকবে। এছাড়া ‘জ্ঞান ও সমৃদ্ধির দেবী উভয়ই পদ্মের ওপর অধিষ্ঠিত’ বলে জানান তিনি।
লোগোতে পদ্মের সাতটি পাপড়ির তাৎপর্যও তুলে ধরেছিলেন তিনি। জানান, সাত মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে পদ্মের সাত পাপড়ি। সর্বজনীন ভাষায়, নোটের সংখ্যাও সাতটি। প্রতিটি নোটের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা থাকা সত্ত্বেও সাতটি নোট একত্রিত হলে একটি নিখুঁত সাদৃশ্য তৈরি হয়। একইভাবে জি-২০’র লক্ষ্য বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিশ্বকে একত্রিত করা।’
৫০০ পুরাকীর্তি দেখাবে দিল্লি
আসন্ন জি-২০ সম্মেলনে ৫০০ পুরাকীর্তি দেখাবে নয়াদিল্লি। শনিবার পুরাকীর্তি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন সম্মেলনে অংশ নেওয়া নেতাদের পত্নীরা। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘শিকড় ও গন্তব্য : অতীত, বর্তমান ও চলমান’ এই শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। পুরাকীর্তি প্রদর্শনীর আয়োজনে আছে দিল্লিতে অবস্থিত বিশ্বের বৃহৎতম আধুনিক শিল্প জাদুঘর ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট (এনজিএমএ)। ১২ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।
প্রদর্শনীর জন্য পুরাকীর্তিগুলো কলাকাতার ভারতীয় জাদুঘর, চেন্নাইয়ের সরকারি জাদুঘর, দিল্লির জাতীয় জাদুঘর, মথুরা আর্ট মিউজিয়াম, চণ্ডীগড়ের সরকারি জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রদর্শনীর জন্য ১৯টি গান্ধার ভাস্কর্য, আখনুর থেকে তিনটি পোড়ামাটির ভাস্কর্য, নাগাপট্টিনমের দুটি বৌদ্ধ ধাতব ভাস্কর্য ও দুটি পাহাড়ি ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্ম পাঠিয়েছে চণ্ডীগড়ের জাদুঘর।
চেন্নাই থেকে পাঠানো হয়েছে অমরাবতী ও দক্ষিণ ভারতে ১০ থেকে ১৩ শতকের মধ্যে তৈরি ব্রোঞ্জ-কাস্ট ভাস্কর্যের একটি অংশ চোল ব্রোঞ্জ, সাতবাহন রাজাদের নির্মিত একটি বৌদ্ধ স্তূপের অবশিষ্টাংশ । প্রদর্শনীতে আরও থাকবে ২ হাজার বছরের পুরনো অমরাবতী মার্বেল।
এছাড়া এতে ভারতের উত্তরপ্রদেশে সানৌলি গ্রাম খননের সময় ভারতের প্রত্মতাত্ত্বিক জরিপের (এএসআই) ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে খুঁজে পাওয়া ৪ হাজার বছরের পুরোনো একটি রথ প্রদর্শন করা হবে।
বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল
ভারতে আসন্ন জি-২০ সম্মেলনকে ঘিরে বন্ধ থাকবে কিছু মেট্রো স্টেশন। এ প্রেক্ষিতে সোমবার একটি পরামর্শ জারি করেছে দিল্লি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। পরামর্শে বলা হয়, শুধু ভিভিআইপি অতিথিদের আগমনের সময় কয়েকটি মেট্রো স্টেশন বন্ধ থাকবে। নির্দিষ্ট গেট ছাড়া অন্যান্য জায়গায় মেট্রোর চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলে উল্লেখ করা হয় এতে।
ডিসিপি মেট্রোর জি রাম গোপাল নায়কের একটি চিঠি অনুযায়ী, মোট ৩৯টি মেট্রো স্টেশনে নিরাপত্তা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চিঠিতে সুপ্রিমকোর্ট, জনপথ, ভিকাজি কামা প্লেস, খান মার্কেট ও ধৌলা কুয়ানের মতো কিছু স্টেশনকে ‘সংবেদনশীল’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অতিথি সেবায় ৫০ অ্যাম্বুলেন্স
জি-২০ সম্মেলনে অতিথি সেবায় থাকছে ৫০টি অ্যাম্বুলেন্স। অতিথিদের সার্বক্ষণিক সেবায় পর্যাপ্ত চিকিৎসাকর্মীসহ সম্মেলনস্থল ভারত মন্ডপম, হোটেল ও বিমানবন্দরে অ্যাম্বুলেন্সগুলো মোতায়েন করা হবে। সোমবার অফিসিয়াল সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের যে কোনো মেডিকেল জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, নয়াদিল্লির ড. রাম মনোহর লোহিয়া হসপিটাল (আরএমএল) ও অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স (এআইআইএমএস)-এর মতো হাসপাতালগুলো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রেখেছে।
বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ১২০০ এলইডি প্যানেল
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসাবে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ১২০০ ছোট এলইডি প্যানেল স্থাপন করেছে নয়াদিল্লি মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল (এনডিএমসি)। পুনর্গঠন করেছে ২৫০টি বৈদ্যুতিক বাক্স। বৃহস্পতিবার এনডিএমসি’র ভাইস চেয়ারম্যান সতীশ উপাধ্যায় এ তথ্য জানিয়েছেন।
সতীশ উপাধ্যায় বলেন, শহরে নান্দনিক আনন্দদায়ক এক পরিবেশ তৈরিতে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি শুধু শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয় বরং জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অবদান রাখবে একটি অর্থবহ উপায়ে। বৈদ্যুতিক বাক্সগুলো এখন সৃজনশীলতা আর সংস্কৃতির প্রাণবন্ত প্রদর্শন।
চোখ ধাঁধানো এই এলইডি প্যানেলগুলো কোনো সাধারণ স্থাপনা নয় বলে জানান সতীশ উপাধ্যায়। প্যানেলগুলো ভারতীয় সংস্কৃতি, প্রাণী, বিভিন্ন শিল্পকর্ম চিত্রিত বার্তা, ছবি ও ফটোগ্রাফ দিয়ে সাজানো হয়েছে। এছাড়া জি-২০ সম্মেলনের লোগো প্রদর্শন করা হবে এতে।
পথকুকুর সরিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভ
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন ঘিরে নয়াদিল্লির রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পথকুকুর। ধাতব তারের ফাঁদে বন্দি করে স্থানান্তরিত করা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে। কুকুর সরানোতে কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রাণী অধিকারকর্মীরা।
প্রাণী অধিকারকর্মী ও হাউজ অব স্ট্রে অ্যানিমেলস (এইচএসএ) ডিসপেনসারির প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় মহাপাত্র কুকুর ধরতে ব্যবহৃত পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। ভারতের প্রাণী কল্যাণ বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী, কুকুরগুলোকে স্থানান্তর করতে সাধারণ জাল ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল বলে জানান তিনি। ধাতব তার ব্যবহার করে কুকুরগুলোকে নৃশংসভাবে ভ্যানে টেনে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া স্থানান্তরিত কুকুরগুলো শনাক্তকরণ নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কীভাবে তাদের আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সঞ্জয় মহাপাত্র।
তবে কুকুর সরানোর ব্যবস্থায় কোনো অন্যায় হয়েছে বলে মনে করে না নয়াদিল্লির মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন (এনডিএমসি) কর্তৃপক্ষ। এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যের সময় এনডিএমসি’র ভাইস চেয়ারম্যান সতীশ উপাধ্যায় বলেন, কুকুরগুলোকে স্থানান্তরের সময় কোনো বর্বরতা প্রকাশ পায়নি।
বদলে যাচ্ছে ভারতের নাম
এই প্রথম ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’-এর পরিবর্তে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রোপদী মুর্মু । ৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে জি-২০ সম্মেলনের অতিথিদের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে প্রথমবারের মতো এ পরিবর্তনে শোরগোল পড়ে গেছে দেশটির সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ ধরনের আমন্ত্রণপত্রে এতদিন ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ লেখা হতো। বিষয়টির আপত্তি জানিয়ে একটি টুইট করেছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ। লিখেছেন, ‘তাহলে এই খবরটি সত্যিই হলো।’ আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংসদের পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশনে দেশের নাম পরিবর্তন করে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত করার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘ভারত’ নামকরণের এই পদক্ষেপকে সেই ইঙ্গিত হিসাবেই দেখছে দেশটির গণমাধ্যম।