• বুধবার, ১০ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০৩ পূর্বাহ্ন

শাহিনুর হয়েছে ২৪ বছর বয়সেই

Reporter Name / ১৫৯ Time View
Update : মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩

২৪ বছরের তরুণ শাহিনুর রহমান। বাবার একমাত্র ছেলে তিনি। কৃষক বাবার স্বপ্ন ছিলো ছেলে বড় হয়ে বাবাকে কৃষি কাজে সহযোগিতা করবেন। তবে শাহিনুরের স্বপ্ন ছিলো তিনি প্রকৌশলী হবেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি বেছে নিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিং তথা অনলাইনে উপার্জনের পথ। এখন ঘরে বসেই আয় করছেন প্রচুর বৈদশিক মুদ্রা। পথচলার কয়েক বছরেই কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। নিজের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন এলাকার বেশ কয়েকজন তরুণেরও।

শাহিনুর রহমানের বাড়ি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বড়দাপ গ্রামে। তিনি দবিরুল ইসলাম ও রহিমা বেগম দম্পতির ছেলে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন এই তরুণ।

শাহিনুরের শৈশব মোটেও ভালো ছিলো না। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট শাহিনুর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তবে কৃষক বাবর অভাবের সংসারে শহিনুরের পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে পরিবারের জন্য। তারপরও নিজের মনোবল ঠিক রেখে বাদ দেননি পড়ালেখা। বড় বোন শারমীন আক্তার এবং দুলা ভাইয়ের সহযোগিতায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন প্রকৌশলী হবার।

শাহিনুর জেএসসি পাশ করেন জিপিএ-৫ পেয়ে। এরই মধ্যে ছন্দপতন ঘটে শাহিনুরের সব স্বপ্নের। অভিভাবক তুল্য দুলাভাইয়ের মৃত্যুতে সব কিছুই হয়ে যায় এলোমেলো। হতাশা নেমে আসে পুরো পরিবারে। তবে পিছু হটেননি শাহিনুর। অভাবের মধ্যেই ২০১৬ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং ভর্তি হন একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। পাশাপাশি শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ।

কাজে শুরুর প্রথম দিকে প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা উপার্জন করতেন শাহিনুর। এখন তার প্রতিমাসে আয় ৪ থেকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।

রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে শাহিনুর বলেন, ‘শুরুর দিকের পথচলাটা মোটেও সহজ ছিলো না। পদে পদে ছিলো নানা প্রতিবন্ধকতা। তবে প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এখন আমার একার উপার্জনেই চলছে পুরো পরিবার। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও অবদান রাখছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পর বোন এবং ভাগ্নের দায়িত্ব এসে পড়ে বাবার ওপর। এ অবস্থায় আমার পড়ালেখা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য টিউশনির পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতো সবসময়। একটা সময় ফ্রিল্যান্সিং এর বিষয়টি মাথায় আসে। কিন্তু ল্যাপটপের অভাবে কাজ শুরু করতে পারছিলাম না। বাড়ি থেকে ল্যাপটপ কিনতে চাইলে বাবা অপারগতা প্রকাশ করেন। যখন বুঝিয়েও পারছিলাম না তখন বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেই। এক পর্যায়ে বাবা কিস্তিতে একটা ল্যাপটপ কিনে দেন। সেই দিয়ে পথচলা শুরু।’

শাহিনুর বলেন, ‘প্রথম কাজ শুরু করি অনলাইন মার্কেটিং প্লেস ‘আপওয়ার্কে’। ২০১৭ সাল থেকে চেষ্টা করলেও প্রথম আয়ের দেখা পাই ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর। এই মার্কেট প্লেস থেকে এখন পর্যন্ত উপার্জন করেছি ১ লাখ ২৬ হাজার মার্কিন ডলার। পাশাপাশি ‘ফাইভার’ নামক মার্কেট প্লেস থেকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার উত্তোল করেছি। এছাড়া আমার নিজের প্রতিষ্ঠান ‘লিড ডিসকোভারি’ থেকে প্রচুর ডলার উপার্জন করছি। গত ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে টোটাল আয় করেছি ১১ লাখ টাকা। আমার ‘লিড ডিসকোভারি’ নামক প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু যুবকের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছি। একই সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমার কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় ২০ জন সফল ফ্রিল্যান্সার হয়েছেন।’

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে অনলাইন উপার্জনে ঝুকলেন কেন? জানতে চাইলে শাহিনুর বলেন, ‘ডিপ্লামা পাশ করে চাকরি করতে চাইলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা বেতন পেতাম। সরকারি চাকরি হলে হয়তো আরেকটু বেশি পেতাম। কিন্তু বৈধ উপায়ে মাসে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করা কখনোই সম্ভব না। অনেকেই বলে সরকারি চাকরির শেষে একটা মোটা অংকের টাকা পাওয়া যায়। তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য হলো- আমি যদি প্রতিমাসে অনলাইন থেকে এক লাখ টাকাও আয় করি, সব খরচ বাদে আমার সঞ্চয় থাকবে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা। ১০ বছর পরে এই জমানো টাকাটা কি মোটা অংকে দাঁড়াবে না?’

যারা নতুন ফ্রিল্যান্সার হতে চান, তাদের প্রতি পরামর্শ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় নতুনরা ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে। এতে অনেকের মনবোল নষ্ট হয়ে যায়। ভালো প্লাটফর্ম থেকে কাজ শিখতে পারলে ভবিষ্যত উজ্জল। তবে পরিশ্রম এবং ধৈর্য্যের বিকল্প নেই।’

এদিকে, একমাত্র ছেলের সফলতায় গর্বের শেষ নেই বাবা দবিরুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলায় অনেক দুষ্ট ছিলো। আমি কৃষি কাজ করি, কিন্তু তাকে কাজে নিতে পারতাম না। যখন ল্যাপটপ-মোবাইল নিয়ে বসে থাকতো ভাবতাম ছেলেটা বেপরোয়া হয়ে গেছে। সে ভালো কিছু করবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আলহামদুলিল্লাহ প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি করেছে। আমার ছেলেকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই।’ ছেলের জন্য দোয়া চেয়েছেন তিনি।

শহিনুরের প্রতিবেশি অ্যাডভোকেট ফরহাদ বলেন, ‘আমি জানতাম শাহিনুর ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু এত পরিমাণ টাকা উপার্জন করে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। আমাদের এলাকার ছোট ভাই এত অল্প বয়সে তার যে সাফল্য তাতে আমরা গর্ববোধ করি। তাকে সবরকম ভালো কাজে পাশে পাই। সে এগিয়ে যাবে, তার মাধ্যমে অনেকের বেকারত্ব ঘুচবে এই প্রত্যাশা আমাদের।’

আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকুল আলম হালিম বলেন, ‘আমি জেনেছি শাহিনুর একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোন সাপোর্ট প্রয়োজন হলে আমরা তার পাশে থাকবো। এছাড়া আমাদের বেকার যুবকরা যেন ফ্রিল্যান্সিং এ উদ্বুদ্ধ হয় এবং বেকারত্ব ঘুচাতে ভূমিকা রাখে এজন্য শাহিনুরের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে একটি সেমিনার করার পরিকল্পনা রয়েছে।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category