• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:০১ অপরাহ্ন

আইন ছাড়াই উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের স্বচ্ছতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।

Reporter Name / ৬৮ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

-রিন্টু আনোয়ার
শিগগির-শীঘ্র শব্দটির অর্থ-প্রতিশব্দ আছে। দ্রুত, জলদি ধরনের প্রতিশব্দ থাকলেও কতোদিনে ’শিগগির বা শীঘ্র ’ হয়- কোনো ব্যাখ্যা নেই। জবাবও দেওয়ারও কেউ নেই। গত ৫১ বছরেও বাংলাদেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার প্রশ্নে ’শিগগির’ শেষ হয়নি। সংবিধানে বিচারক নিয়োগে আইনের কথা থাকলেও গত ৫১ বছরে কোনো সরকার এই আইনটি করেনি। ভাবতে কেমন লাগে বেআইন, বিনা আইন বা আইন ছাড়াই একটি স্বাধীন দেশের উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ হয়? নিয়োগের পর উচ্চ বেতন, বোনাস, বিশেষাধিকার, পদোন্নতি, ছুটি, পেনশন, পেনশনকালেও বড় বড় পদে বহালসহ সবই হয়ে যাচ্ছে।রয়েছে উৎসব ও বাংলা নববর্ষ ভাতাও। প্রধান বিচারপতির জন্য তো অবসরের পর আজীবন গৃহসহায়ক, গাড়িচালক, দারোয়ান সেবা, সাচিবিক সহায়তা এবং অফিস কাম বাসভবনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা বিশেষ ভাতাও আছে। অথচ এতো কিছু থাকার পরও তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোন আইন নেই।
শিগগিরের সঙ্গে-ই প্রত্যয় যোগ করে ‘শিগগিরই’ উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন হবে বলে এ বছরের শুরুর দিকেও জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী।  সেই শিগগিরটা কবে? কতোদিনে? সংবিধান অনুযায়ী এখন উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্যতার কথা বলা থাকলেও যোগ্যতার মানদণ্ড অস্পষ্ট-আপেক্ষিক তথা মনমরজি বা বিচেনার ওপর। সেটাই চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের (গ) ধারায় স্পষ্ট আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। বিচারক নিয়োগে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট কিছু নির্দেশনাও আছে। আইন না থাকা এবং ওই নির্দেশনা না মানায় এ পদে নিয়োগের স্বচ্ছতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।
২০০৯ সালের ২ মার্চ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক রায়ে জোট সরকারের সময়ে বাদ পড়া ১০ বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ দফা নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ গ্রহণ সাংবিধানিক রেওয়াজ। এ রেওয়াজ সাংবিধানিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে। এটা আইনের শাসনের অংশ, বিচারক নিয়োগ ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বা মতামত প্রাধান্য পাবে। তবে তাদের পেশাগত যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের মতামত নেওয়া হবে। এর ৮ বছর পর ২০১৭ সালে আরেকটি নির্দেশনা। এটি ৭ দফার। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা দেন।
তখনকার বিচারপতি বতর্মানে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাকে প্রয়োজনে বিচারক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের দুজন করে জ্যেষ্ঠ বিচারকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতি যে মতামত দেবেন, তা অগ্রাহ্য করা যাবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী একজন বিচারকের পরিপক্কতা পেশাগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে একটি বয়সসীমা ধরা হয়েছে। সেই হিসাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক মনোনয়নের ক্ষেত্রে বয়স সর্বনিম্ন ৪৫ বছর হওয়া উচিত। ২০১২ সালে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে এ নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে খসড়া নীতিমালা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল খসড়া নীতিমালায়। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের বিচারক নিয়োগের বিধান অনুসরণ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি, অভিজ্ঞ আইনবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে খসড়াটি প্রণয়নও করা হয়েছিল। কিন্তু আজতক আইনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। কেবল ‘শিগগির’ হয়ে যাওয়ার কথা শোনানো হচ্ছে। আর মাঝেমধ্যে কিছু চিারপতি নিয়োগ হয়ে যান যথারীতি। ফলে এ পদে নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে একদিকে বিরোধীমত থেকে  প্রশ্ন উঠেই চলছে। আরেক দিকে এর সমথর্নে খুশি ক্ষমতাসীনরা। এই ’শিগগির’ বাস্তবতায় চলছে একটি দেশের বিচারপতি নিয়োগাবলী। এর পরিনাম যা হবার হচ্ছে। দেশের মানুষ এ নিয়ে নিচু মানের সমালোচনা করে। আজেবাজে কথা বলে। মশকরা-তাচ্ছিল্যও করে। যা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরেও।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখন বিশ্বসংস্থাগুলোর কাছেও সাবজেক্ট। মার্কিন ভিসানীতিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিচার বিভাগকে। এর মাঝেই ঝেড়ে কাশি দেওয়ার মতো একজন বিচারপতি বলে বসেছেন, বিচারপতিরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ। তাও খোদ আপিল বিভাগের বিচারপতি তিনি। তার এমন উচ্চারণে তাজ্জব-হতবাক অনেকে। তিনি কী করে এমন কথা বললেন বা বলতে পারলেন? এর প্রতিবাদকে  সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া হয়েছে। পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নেমে পড়েন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থথিত আইনজীবীরা। এর জেরে আইনাঙ্গন-বিচারালয়েও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা। ধাওয়া-ধাওয়ি। বিভিন্ন ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের মিছিল-সমাবেশ করার নজির পূর্বের ইতিহাস ভঙ্গ করে চলছে দিনের পর দিন। সম্প্রতি আদালতের এজলাসেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে একটির পর একটি। সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের কোনো বিভাগ অন্য বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিচারপ্রক্রিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইনের খেলাপ হলে আদালতই তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন। আদালত ভুল করলে তার সমাধানও আদালতেই হতে হবে। এতো মযাদা ও সম্মানস্থলটিই এখন নানা অপঘটনায় ভারাক্রান্ত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মতো রাজনৈতিক কর্ম হয়েছে সেখানে। বিরোধী রাজনীতিকদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা সেখানে। হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় লাখ লাখ আসামি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গায়েবি মামলা, গণগ্রেফতারের শিকার মানুষকে মাসের পর মাস জামিন না দেয়ার একরোখা কাজও হচ্ছে। খোদ বিচালয়েই এ অবস্থা চলতে থাকলে আর বাকি থাকে কী? সেখানে রাজনীতির ষোলকলা যেভাবে ভর্তি হচ্ছে তাতে বিচারবিভাগ নিয়েই নানা উৎকণ্ঠা ঘুরছে। এসব ঘটনাদৃষ্টে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন ভিসানীতি। যেখানে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে।  আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম, হস্তক্ষেপ ও বাধা দান করা হলে এর সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এটি অনুসারে ভুয়া ভোট প্রদান, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধা দান, নির্বাচনী সমাবেশে হামলা, গায়েবি মামলা প্রদান, নির্যাতন-নিপীড়ন, মতপ্রকাশে বাধা দান ইত্যাদি কাজ নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি মূলত অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দেশটির নিবিড় নজরদারিরই অংশ। এ নজরদারির মঝেই বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক রায় হচ্ছে, পুরনো মামলা সক্রিয় করে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে বিরোধী দল-মতকে।
যুগপৎ সক্রিয়তা উন্নয়ন অংশীদার, সহযোগীদের দৃষ্টি কেড়েছে। তাই তারা চলমান প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষিতে কথা বলছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে। আদালতের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসকে নাজেহাল। অপছন্দের মহল বা বিরোধীমতের লোকদের আইনি প্রক্রিয়ায় নাজেহালের সময়টাতে কাথা মতো না চলায় দীর্ঘদিন সরকারের পক্ষে আইনি লড়াই পরিচালনাকারী একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকেও বরখাস্ত করে দেয়া হয়।তিনি আবার গিয়ে ওঠেন ঢাকাস্থ মাকির্ন দূতাবাসে। তার পর্ব শেষ না হতেই মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান শুভ্র এবং সংস্থার পরিচালক এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে ২ বছর কারাদণ্ডাদেশ। বাংলাদেশের আদালতের এ ধরনের আচরণ একে একে আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে উঠছে বিশ্বমিডিয়ায়। বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টেও ওঠছে বিষয়গুলো। পাশাপাশি বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানাচ্ছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের বিচারালয়ে কী হচ্ছে, কে সেখানে কী ভূমিকা রাখছেন, আইন-আদালত ও বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের প্রবেশ কিভাবে-এসব তথ্যও এখন জেনে নিচ্ছে আন্তজাতিক মহল। বিষয়টি কারোর জন্যই শুভ নয়। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর বিদায়ের সময়ের কয়েকটি কথা এখানে খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি বলে গেছেন- বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃদপিণ্ড। একটি জাতির শাসন বিভাগ বা আইন বিভাগের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে খারাপ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।কলম-কালিতে আর কারও ভাগ্য নির্ধারণ করবেন না। আর কাউকে দেবেন না ফাঁসি, যাবজ্জীবন কিংবা বেকসুর খালাস।
বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা সহজাত। সবাই বিচারকদের শ্রদ্ধা করেন। এটাই তাদের পাওনা। বিচারকরা যখন অবসর নেন, তার পরও আইন পেশায় যুক্ত হলে বিচারকের চেয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ‘মাই লর্ড’ শব্দটা উচ্চারণ করেন। এতে বিন্দুমাত্র তাদের অনীহা দেখা যায় না। আইনের রক্ষকদের কাছে এছাড়া আমজনতার আর কি-ইবা চাওয়ার আছে।
যে কাজ চেয়ারে থেকে করার কথা, সেটা এর বাইরে মানায় না। সময়ের কাজ সময়ে না করার রোগ যাদের, তাদের দ্বারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে।
রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে যেভাবে ধাবমান তা বিচারলয়ের জন্য চরম অমঙ্গলের আভাস। তারপর বিদেশিদের কাছে অবিরাম সমালোচনার বিষয় হয়ে পড়া আমাদের জন্য  আরো বেদনার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category