• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২২ পূর্বাহ্ন

গরুর মাংসে গোঁয়ার্তুমি: ভাইরালের খেল

Reporter Name / ১১ Time View
Update : বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার
মাংস-মাছ, তরমুজ বা সবজি। ইট আর পাথর। রমজান বা ঈদ। যে কোনো সময় বা যে কোনো পণ্যের দাম আসলে কিছুই নির্দেশ করে না, ভোক্তার ক্রয়-সামর্থ্যই  আসল কথা। কারো কারো কাছে সেটাই গণ-উন্নয়ন। গোটা শরীরকে বঞ্চিত করে শুধু ভুড়িটাকে মোটা বানানোও যেমন স্বাস্থ্যবান হওয়া।  সবদিকেই হিসাব এমন প্রায় এমনই। কোনো দেশে কোনোকালে নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের দাম কতো, আর ক’জনের তা কিনে খাওয়ার সামর্থ আছে, তাও আর বিষয় নয়। সব পণ্য বিক্রি হয়ে গেছে; অতএব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আছে বা বেড়ে গেছে!
রমজানের আগ থেকেই মাংসের বাজারে চণ্ডালতা।  বাজারভেদে নির্ধারণ। যে যেখানে যেভাবে যা পারছে করে ছাড়ছে। একই দোকানে এক কেজি মাংস দুই তিন দরে বিক্রির ঘটনাও আছে। সবমিলে বাজারে এককেজি গরুর মাংস কোথাও ৬৫০ টাকা, কোথাও ৭৫০ টাকা আবার কোথাও ৯’শ- ১০০০ টাকাও। ভোটের আগে হু হু করে কমতে শুরু করে মাংসের দাম। ৬০০ টাকার নিচেও নেমে যায়। ৮০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। ওই নমুনায় ৬৫০ টাকা প্রতিকেজি গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। একমাস সেই দর কার্যকর থাকলেও ভোটের পর থেকে ফের বাড়তে থাকে দাম।  সময়, রাজনীতি, নির্বাচন, হাড্ডি, চর্বি, ওজন, খলিল-নয়ন-উজ্জ্বল সব মিলিয়ে গরুর মাংস নামক পণ্যটি ম্যাজিকে ভরা। যা ইচ্ছা কাণ্ড করা যায়। সবই ঠিক। সবকিছুই যুক্তিতে ভরা।
এসবের পক্ষে-বিপক্ষে সব দিকেই তথ্য আছে। অজুহাত বা যুক্তি তো অবারিত। এর মাঝেই সিন্ডিকেট ভাঙলে মাত্র ৫০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব বলে মনে করছে ব্যবসায়ী সমিতি। তারা বলছেন, অসাধু চক্রের হুমকিতে পড়তে হচ্ছে স্বল্পমূল্যে গরুর মাংস বিক্রেতাদের। এ অবস্থায় আলোচিত গরুর মাংস বিক্রেতা ঢাকার শাহজাহানপুরের খলিল জানিয়েছেন, রোজার ঈদের পর ব্যবসাই ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে এখনও খলিলসহ ঢাকার নয়ন ও উজ্জ্বলরা হ্রাসকৃত দামে ছয় শ থেকে সাড়ে ছয় শ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করছেন। রাজধানীর বাজারে যখন গরুর মাংসের দাম সাত শ থেকে সাড়ে সাত শ টাকা, তখন শাহজাহানপুরের খলিল গোশত বিতানে ৫৯৫ টাকা দরে মাংস কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। নিরাপত্তা রক্ষায় সেখানে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ।
হঠাৎ গরুর দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে এক শ টাকা বাড়িয়ে মাংস বিক্রির ঘোষণা দিয়েও দুদিনের মাথায় তা থেকে সরে আসেন ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। লোকসান হলেও কথা রাখতে ২০ রোজা পর্যন্ত আগের দামেই বিক্রি করছেন মাংস। তবে নানা জটিল পরিস্থিতিতে গরুর দাম বাড়ার কথা জানিয়ে খলিল বলছেন, ঈদের পর তিনি ছাড়ছেন ব্যবসা। মিরপুর ১১ এর উজ্জ্বল গোশত বিতানে সম্প্রতি ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৩০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। তাঁর দাবি, লাভ-লোকসানের চেয়ে মানুষের উপকারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। পুরান ঢাকার কসাইটুলির নয়নও মাংস বিক্রি করছেন ৬৩০ থেকে ৬৫০ টাকায়। দিনে ৩০ থেকে ৩৫টি গরু বিক্রির কারণে মোটামুটি ভালই লাভ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মাংস ব্যবসায়ী সমিতি বলছে, খামারীদের সিন্ডিকেটের কারণে গরুর মাংসের দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের বাইরে। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দাম বেঁধে দেওয়া ২৯ পণ্যের তালিকায় গরুর মাংসও রাখার সমালোচনা করেন সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি জানান, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী ফার্মার অ্যাসোসিয়েশন যে কোনো সময় গরু কিনতে পারে এই সুযোগটাই তারা নিচ্ছে। সামনে কোরবানি, খলিল মাংসের দাম কমিয়ে দেওয়ায়, গরুর দাম কমে গেছে। সারা বাংলাদেশের ফার্মাররা আতঙ্কিত হয়ে গেছে। পরে তারা বাজার থেকে গরু উঠিয়ে নিয়েছে। এভাবে সিন্ডিকেট ভাঙলে মাত্র ৫০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দর ৬৫০ টাকা বেঁধে দেয়া ছিল ওই খেলারই অংশ। নির্বাচনের পর ঢাকায় কোথাও সেই মাংস বিক্রি হয় ৫৯৫ টাকা, কোথাও ৭০০ থেকে ৮০০। একই পণ্যের দামে এতো ফারাকেও খেলা। যারা কম দামে বিক্রি করছেন , তারা লোকসান দিয়েছেন? নাকি অন্যরা বেশি লাভ করছেন? দুয়েক কথায় এসব প্রশ্নের নিস্পত্তি হবে না। গত বছরের শেষের দিকে ৫৯৫ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি করে ব্যাপক আলোচিত হন ঢাকার শাহজাহানপুরের ব্যবসায়ী মো. খলিল। এবার রমজানের শুরু থেকে তিনিসহ সমমনা অর্ধশত ব্যবসায়ী একই ন্যূনতম দামে বিক্রি করছেন। এই ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, মাংস বিক্রিতে ‘তেমন লাভ’ করেন না। তাদের লভ্যাংশ আসে গরুর নাড়ি-ভুড়ি, চর্বি, শিং ইত্যাদি বিক্রি করে। দেখা গেল, প্রতিটা গরুর গোশতে পাঁচ হাজার টাকা লস, কিন্তু নাড়িভুঁড়িতে আয় ২০ হাজার। অন্যদিকে, যারা সাতশ বা আটশ টাকা নিচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই তাদের ব্যবসার হার এক নয়। ফলে, তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখানে কার কথা সঠিক। সবাই সঠিক! মিথ্যা বলেন না তারা। তাদের কেউ ফেলনাও নন। খেলটা সবাই খেলছেন যার যার জায়গা থেকে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে গরু-মুরগির মাংস ও ডিম বিক্রি করা হচ্ছে রাজধানীর ৩০টি পয়েন্টে। এগুলোতেও আরেক খেলা ও কাণ্ড।  বিশেষ করে গরুর মাংস আর দুধ নিয়ে।
কম মূল্যে গোশত বিক্রিতে হইচই ফেলে দেয়া কয়েক ভাইরাল ব্যবসায়ীর কারণে অন্য ব্যবসায়ীদেরও জবাবদিহি করতে হয়েছে। খলিল-নয়ন ও উজ্জ্বলের দাবি, ৫৭০ টাকায় গোশত বিক্রি করেও তারা লাভ করছেন। তবে লাভের পরিমাণ কম। আলোচিত এ ব্যবসায়ীদের দাবিকে অযৌক্তিক, বিভ্রান্তিকর বলে দাবি করেছেন অন্যান্য গরুর গোশত ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, আলোচিত ব্যবসায়ীরা যা করছেন সেটা মানুষের সাথে প্রতারণা। কোন চোর ছাড়া বর্তমান বাজারে ৬শ’ টাকারও নিচে গরুর গোশত বিক্রি সম্ভব নয়। এর পেছনে গোপন কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। শাহজাহানপুরের খলিল বড় ব্যবসায়ী। ফানিচারসহ অনেক ব্যবসা তার। এসব ব্যবসার সম্প্রসারণে তার ভাইরালে থাকা জরুরি। রমজান মাসজুড়েই ৫৯৫ টাকা দরে গরুর মাংস বিক্রির ঘোষণা দিলেও সুচতুর খলিল হুট করে ১০ রোজা থেকে গরুর মাংসের দাম ১০০ টাকা বাড়িয়ে কেজি ৬৯৫ টাকা করেন। এতে সমালোচনার মুখে পড়েন আলোচিত এই মাংস ব্যবসায়ী। এ পরিস্থিতিতে ২৪ মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে বর্ধিত দাম কমিয়ে আবারও আগের ৫৯৫ টাকা দামে মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত জানান খলিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মার্চ সকাল থেকে আগের দামে অর্থাৎ ৫৯৫ টাকা কেজি গরুর মাংস বিক্রি শুরু করেন তিনি।
মিরপুরের ব্যবসায়ী উজ্জ্বল দেনায় জর্জরিত। এক সময়ে গাবতলি হাট থেকে গরু কিনলেও এখন সেখানের পাওনাদারদের ভয়ে সেদিকে মুখ ঘোরাচ্ছেন না। অর্ধ কোটি টাকার কাছাকাছি তিনি দেনাগ্রস্ত। এসব দেনার একমাত্র কারণও ব্যবসায় লস হওয়া। উজ্জ্বল তার লোকজনের মাধ্যমে আশপাশের এলাকায় জবাই করা গরুর চর্বি ৭০ টাকা করে কিনে আনেন। যা তার দোকানে গোশতের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করেন বলে তথ্য আছে আশপাশের ব্যবসায়ীদের কাছে।
অপরদিকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নয়ন আহমেদ আগে খাশির গোশত সাপ্লাই দিলেও বছর খানেক ধরে তিনি গরুর গোশত বিক্রি করেন। তবে আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, নয়ন আহমেদ নিজেই একজন গরু চোর। গত বছরের শেষ দিকে গাড়িতে করে চোরাই গরু সরবরাহকালে ওয়ারী থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। জেল খাটেন কয়েকদিন। এলাকাবাসী জানায়, জাতীয় নির্বাচনে তার পছন্দের এক প্রার্থীর বিজয় উৎসব ও উপহার হিসেবে তিনি ৫শ’ টাকায় গরুর গোশত বিক্রি করেন। ওয়ারী থানা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের শেষ দিকে তিনি চোরাই গরু ও পরিবহনসহ কয়েকজন সঙ্গীসহ গ্রেফতার হন। তবে নয়নের দাবি, পুলিশ তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়েছে। তার মতামত হলো, জনসেবার জন্যই তিনি কম দামে গোশত বিক্রি করেন। রোজার শুরুতে কয়েকদিন খলিল-নয়ন ও উজ্জ্বরা যে পরিমাণে কুপিয়েছেন এখন তাদের কিছুদিন অফ গেলেও সমস্যা নেই। এ ছাড়া কিছু কারসাজি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাদের কারো কারো গা ঢাকা দেয়াও সময়ের ব্যাপার।
এরা ছাড়াও অতি মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য এবং সিন্ডিকেটের কাছে সাধারণ মানুষ সবসময়ই অসহায়। তথাকথিত ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠী একজোট হয়ে কোনো একটি পণ্যের দাম এমন নির্ধারিত অংকে আটকে রাখেন, যাতে এর চেয়ে কম দামে কেউ বিক্রি করতে না পারেন। এজন্য তারা অবৈধ মজুতদারিরও আশ্রয় নেন। কোনো একটি পণ্যের দাম কেজিতে দশ টাকা বাড়লেও যখন সেটি শত শত টন বিক্রি হয়, তখন একদিনে কোটি কোটি টাকা তারা বাড়তি মুনাফা তুলে নেন। এরকম উদাহরণ অসংখ্য।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সম্প্রতি রাজধানীতে এক সেমিনারে বাংলাদেশে মাংসের দাম বৃদ্ধি বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত-পাকিস্তানে গরুর মাংসের দাম কম হলে বাংলাদেশে এত বেশি হবে কেন? এজন্য গবেষণা হওয়া দরকার।
সত্যিই গবেষণা হওয়া প্রয়োজন নাকি সরকার এই প্রশ্নের উত্তর জানে? গবাদি পশু লালন-পালনের খরচ কি বেড়ে গেছে? গোখাদ্যের দাম কি অনেক বেশি? গোখাদ্য এবং অন্যান্য ওষুধের বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করে? তাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে? একটি গরু একজন বিক্রেতার হাত হয়ে বাজারে মাংস হওয়া পর্যন্ত ধাপগুলোয় কত জায়গায় চাঁদা দিতে হয়? এই চাঁদার ভাগ কোথায় কোথায় যায়—এসব প্রশ্নের উত্তর কি রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে? এসব প্রশ্নের সুরাহা করা না গেলে ক’জন খলিলের দাম কমানোর উদ্যোগ গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত-সমালোচিত হবে বটে, তাতে ১৮ কোটি লোকের বাজারে যে বড় কোন পরিবর্তন আসবে না তা বুঝতে বুদ্ধিজীবী হওয়ার দরকার হয় না। বরাবরের মতো অতি মুনাফা লোভী, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিগ্রস্ত বাজারব্যবস্থার কাছে সাধারণ মানুষ হেরেই যাবে।
অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়, দেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নৈতিকতায় খরা দিন দিন যত বাড়বে, বাস্তবতা যা হবার তা-ই হবে। তা গরুর মাংস কি আর তরমুজইবা কি সব কিছুতেই। যখন যেটা নিয়ে করা যায় সেটা নিয়েই চলে। ব্যবসাও চলে। রমজানে জনসেবাসহ নানান মিষ্টি কথায় বিনা খরচে ভাইরালের বাজারও মেলে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category