• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৪:০৩ পূর্বাহ্ন

তাপদাহ-লোড শেডিং: আল্লাহ ভরসার কঠিন বাস্তবতায় দেশ।

Reporter Name / ১৪ Time View
Update : রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

-রিন্টু আনোয়ার

দেশে কিছুদিন ধরে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। একাধিকবার জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবারের তাপপ্রবাহ দেশের ৭৬ বছরের ইতিহাসে সবথেকে বেশি সময় ধরে স্থায়ী থাকার রেকর্ড ভেঙ্গেছে। কবরের আজাব বা দোজখের আগুন; মানুষের বিশ্বাসের বিষয়। দুটোই পরলোকের পর্ব। ইহলোকে ক’দিন ধরে তাপেচাপে মাত্রা ছাড়ানো আজাবে ভুগছে মানুষ। আগুন সইছে। প্রকৃতির বিশেষ করে চলমান তাপদাহ থেকে শিগগিরই মুক্তির কোনো আভাস নেই। বরং তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে আভাস দিয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া অফিস। জাগতিক ভরসা না পেলে মানুষ তখন ‘আল্লাহ ভরসা’র পথ ধরে। গত ক’দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ সেটাই শুরু করেছে। তাপদাহ থেকে মুক্তি ও বৃষ্টি চেয়ে ইস্তিসকার নামাজ ও বিশেষ দোয়া মোনাজাত করছে। এসব দোয়া-নামাজে বিশ্বাস না করা মানুষও সম্প্রতি ঢাকার আফতাবনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইস্তিসকার নামের এই বিশেষ নামাজে শরীক হয়েছে। মোনাজাতে আমিন আমিন বলে চোখের পানি ছেড়েছে। এটাই বাস্তবতা। বিপদে পড়লে, দুনিয়ায় কোনো ভরসা না দেখলে নাস্তিক স্বভাবের মানুষও আল্লাহর নাম জপে, ওপরওয়ালার কাছে ফরিয়াদ করে।  আমাদের বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ভিন্ন। তারা এর সঙ্গে ধর্ম মেলাতে চান না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু উত্তরাঞ্চল বা বাংলাদেশ নয়, ‘এল নিনোর’ প্রভাবে এ বছর ভারত ও আরব মহাসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তাপের এ দাপট। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি গাছ কাটা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণও তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।
সাধারণ মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানের এতো ফের বোঝা সম্ভব না হলেও বিষয়টি মোটামুটি বোধগম্য। গরমের তাড়না কম-বেশি সবার গায়েই লাগছে। বৃষ্টির জন্য চারদিকে হাহাকারও দৃশ্যমান। গোটা দেশে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক কর্মচঞ্চলতা। ফসলি জমি শুকিয়ে গেছে। এর জেরে আমন আবাদসহ আমি ও লিচুর ফলন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দাবদাহ আর অনাবৃষ্টি  চিরকালই এক অভিশাপ। চৈত্র ও বৈশাখের প্রচণ্ড খরতাপে ফসলের মাঠ হয়ে উঠত বিবর্ণ। সব জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানি জোগাড় করাও হয়ে পড়ত দুঃসাধ্য। এজন্য গ্রাম বাংলার মানুষ অপেক্ষা করত বৃষ্টির। বৃষ্টির দেখা না পেলে বাংলার বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বৃষ্টির জন্য তাদের আদি সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতি অনুযায়ী নানা নিয়মাচার ও লোকাচার পালন করত।
কালের পরিক্রমায় বৃষ্টির জন্য বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সেই সমৃদ্ধ অধ্যায়টি আজ এক প্রকার বিলুপ্তই বলে চলে। কিছু কিছু আচার যদিও পালন হয় এখনও। গ্রাম বাংলায় বৃষ্টির জন্য কৃষকদের এক লোকজ অনুষ্ঠানের নাম কুলা নামানি। প্রথমে নতুন একটি কুলায় ধান, বিভিন্ন বনফুল, ধান, দূর্বাঘাস এবং কাকের বাসার কাঠখড় দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামের কোনো এক কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সেই কুলা তুলে দেওয়ার আগে একটি কাঁসার কলসির উপর কুলাটি রাখা হয়। কলসিতে থাকে সোনা-রূপা ভেজানো পানি। সঙ্গে থাকে একটি আমগাছের ডাল। সেই আচারের অংশ হিসেবে ব্যাঙের বিয়ে দেয়ার চলও ছিল এক সময়। আল্লাহ মেঘ দে পানি দে-গাইতে গাইতে বিল বা জলাশয় থেকে ধরে আনা একজোড়া ব্যাঙকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়ার সেই পুরনো তদ্বিরের খবর সম্প্রতিও পাওয়া গেছে।  সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেব সন্তুষ্ট হয়ে শিগগির পর্যাপ্ত বৃষ্টি নামাবেন এবং ওই বছর ধানের উৎপাদন ভালো হবে। ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয় পাহাড়ি সমাজেও। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ব্যাঙের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার মতো সবজি ও চাল সংগ্রহ করে। এরপর বিয়ের আয়োজনকারী বাড়ি গোবর দিয়ে লেপে পবিত্র করে ব্যাঙের বিয়ে আয়োজন করা হয়। বৃষ্টি নামানোর জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন রাতে দলবেঁধে হুদমা গান গেয়ে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, হুদমা মেঘের দেবতা। যদি দেবতা হুদমাকে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে তিনি চাষের উপযুক্ত বৃষ্টির বর্ষিত করবেন।
পৃথিবীর পানিয় জল কাদামাটি নদনদী সবই প্রি মেইড। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার ধংশ নেই, আছে রূপান্তর। পানি জমে বরফ হয়। আর পুড়ে হয় বাষ্প। এই রূপান্তরেই পূর্বনির্মিত গঠণ প্রণালীর উপর চলছে প্রকৃতি, প্রকৃতির বাসিন্দা, জড় ও জীব জগৎ। জগতের অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে মানব দেহের গঠন শৈলী এবং তাঁর চমৎকারিত্ব বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে মানুষের দেহে যেখানে যা প্রয়োজন সেখানে তাইই আছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এমন কিছু নেই যার প্রয়োজন অনাবশ্যক। প্রয়োজনের তাগিদে মূলকে ঠিক রেখে বাড়তি অংশ কেটে বা ছেঁটে দিলে সুবিধা বই অসুবিধা হয় না। কিন্তু মূল অংশে কিঞ্চিত অযাচিত হস্তক্ষেপ হলে বিপর্যয় অনিবার্য্য। যেমন পায়ের আঙ্গুলের নখ বা চাড়ার বাড়তি অংশের চেয়ে এক জাররা বেশি কাটলেই আঙ্গুল অরক্ষিত হয়ে যায়। অরক্ষিত অংশের জ্বালা এবং যন্ত্রনা পুরা মানব দেহকে অস্থির করে তোলে। ঠিক একই ভাবে পাহাড়, নদী, গাছপালা, মাটি, সমুদ্র সমুহের উপর এবং নিচ সবই প্রকৃতির প্রয়োজনে সৃজিত। তাই বলে প্রকৃতি থেকে মানুষ যে কোন কিছু নিতে পারবে না তা নয়। মানুষের যা প্রয়োজন প্রকৃতিতে থেকে মানুষ অবশ্যই তা সংগ্রহ করবে। যেমন গাভীর শরীরে যে দুধ আছে তার পুরাটাই বাছুরের জন্য। প্রকৃতির নিয়ম কানুন উপেক্ষা করে প্রকৃতির প্রায় সকল সিষ্টেমের গায়েই মানুষ দুঃখজনকভাবে হাত দিয়ে ফেলেছে। যার ফলে প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে নানা রকমের বিপর্যয়। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কিছুদিন ধরে নতুন করে চলছে প্রকৃতিকে গালমন্দ করা। যত দোষ প্রকৃতির ঘাড়ে চাপানো। প্রকৃতি খারাপ হয়ে গেছে, ক্ষেপে গেছে, চণ্ডাল হয়ে গেছেসহ কত ধরনের দোষারোপ। খরা-বন্যা, রোদ-বৃষ্টি, জলোচ্ছাসসহ নানা অতি ঘটনায় মানুষ প্রকৃতিকে গালমন্দ করছে। প্রকৃতির স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে বলে কথা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি মানবসৃষ্ট নয়। মানুষ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি বলতে এই পৃথিবী তথা গোটা সৃষ্টি জগৎকে নির্দেশ করে। প্রকৃতি জীবন্ত, বিপুল শক্তিশালী, সার্বভৌম চলমান সত্তা। মানুষসহ প্রাণিকুল বেঁচে থাকছে প্রকৃতির দয়ায়-ছায়ায়। এই প্রকৃতি যে সাম্প্রতিককালে রুক্ষ-মহাক্ষেপাটে তা প্রকাশ্যেই। এখানে লুকোচুরি বা আড়াল করার কিছু নেই।
প্রকৃতির সর্বনাশের আসল হোতা মানুষের ক্রিয়াকর্মের কারণেই প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ। বিকল্প ব্যবস্থা থাকার পরও তারা শিল্পের বর্জ্যের বিষ বাতাসে ছেড়ে, পাহাড়, বন, গাছপালা কেটে সাফা করে। বিশ্বময় অস্ত্র, গোলা-বারুদে প্রকৃতিকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা- প্রতিজ্ঞা নিয়েই এগিয়েছে মানব সভ্যতা। জয় করা আর অবিচার করা এক নয়। জয় আর অবিচার গুলিয়ে ফেলায় প্রকৃতিকে মানুষের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যার অনিবার্যতায় খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার সংকট কম-বেশি গোটা বিশ্বেই। নিরপেক্ষ-নির্দোষ প্রকৃতিও বেদরদি হয়ে উঠছে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মানুষের। কিন্তু তাদের নানা কর্মকাণ্ড ও সভ্যতার বিকাশের নামে প্রতিনিয়ত আঘাত পড়ছে প্রকৃতির ঘাড়-মাথায়। এতে প্রকৃতির বিগড়াতে বা মাইন্ড করতে কি সময় লাগে? দেশে প্রকৃতি নিয়ে কথা বলা, কাজ করার লোকও কম। পরিবর্তন প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলেও এর ফল সব সময় খারাপ হয় না। কখনো কখনো ভালো কিছুও হয়। প্রকৃতির সব পরিবর্তন সব সময় মানুষের দৃষ্টির সম্মুখে হয় না। দৃষ্টি ও জ্ঞানের অলক্ষ্যে ঘটা ওই পরিবর্তনের ফল সব সময় জানা হয় না। ওই পরিবর্তনের সুফল-কুফলও থেকে যায় জানার বাইরে।
গবেষকরা বলছেন, গত ১০ বছরে বিশ্বে যত বন্যা, ঝড় ও দাবানল হয়েছে তার সবই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে। বাংলাদেশের প্রকৃতি এর বেশি শিকার। অসময়ে বৃষ্টি, বৃষ্টির মৌসুমে খরা, এক এলাকায় বৃষ্টি, আরেক এলাকায় খরা। শীতকালেও শীতের দেখা মেলে না। প্রকৃতির যথানিয়মের এই খেয়ালের মাঝে তাপদাহে পুড়ছে মানুষ। তারওপর মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের ঘনঘটা। বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিং মোটেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। বৈরী আবহাওয়া ও অসহ্য গরমে জনজীবনে যখন ত্রাহী অবস্থা চলছে, তখনই শুরু হয়েছে বিদ্যুতের এই ভয়াবহ লোড শেডিংয়ের। দিনে-রাতে যখন-তখন বিদ্যুৎ যাওয়া আসার খেলায় মেতেছে। সেচের অভাবে ধানক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে, আমের মুকুল ঝড়ে যাচ্ছে, বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষিজাতপণ্য উৎপাদন। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় কলকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে, কোলরেস্টরেজে পঁচে যাচ্ছে কৃষিপণ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্যান না চলায় তাপপ্রবাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রীক মানুষের জীবন। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজে নষ্ট হচ্ছে খাদ্যপণ্য। তীব্র গরমের মধ্যে টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার যন্ত্রণায় নগরের চেয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ। মানবসৃষ্ট এ যাতনায় সারাদেশের মানুষের ত্রাহি দশা। বিদ্যুতের জন্য হাহাকার থেকে কেন্দ্রে হামলা, মিছিল বের করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
তাপদাহের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকার বিষয়ে কোনো আশার খবর না দিয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জানিয়েছেন, তাপদাহ কমে গেলে লোডশেডিং স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অথচ দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে ব্যাপক সাফল্য দেখানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডের তথ্যও জানানো হচ্ছে ঢাকঢোল পিটিয়ে। এ ধরনের নাফরমানি থেকে বাঁচতেও আল্লাহ ভরসা অবস্থা মানুষের।
বলা হয়ে থাকে- বাজার পুড়লে মাজারও থাকে না; লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। এ ধরনের আরো অনেক কথার প্রচলন আছে আমাদের সমাজে ও লোকসাহিত্যে। কথাগুলোর অর্থ বহুমুখী। আক্ষরিক-আভিধানিকে অনেক তফাত। কোনো রাজ্যে অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে সেখানে আগুন, পানিও আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। শয়তান তথা দুষ্টরাও দমে না। এটি একদম অঙ্কের মতো।

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category